পিরোজপুর জেলায় সড়ক সংস্কার ও প্রশস্ত না করেই এবার ৫৮১ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন শ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ধরা পড়েছে। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলাও করেছে। আর এই অর্থ আত্মসাৎ করেন পিরোজপুর-২ আসনের সাবেক এমপি মহিউদ্দীন মহারাজের ভাই মিরাজুল ইসলাম। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দায়িত্বরত প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নির্দেশে এই লুটপাটের ঘটনা ঘটে বলে ঘটনায় জড়িতরা দাবি করছেন।
তবে অভিযুক্ত মিরাজুল ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। জানা গেছে, ২০২২ সালে দুই হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রামীণ সড়ক প্রশস্ত করার প্রকল্প নিয়েছিল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ওই বছরের ২২ মার্চ প্রকল্প অনুমোদন হয়। প্রকল্পে বরিশাল বিভাগের ৪২ উপজেলা ও ৩৬৩ ইউনিয়নের সড়ক প্রশস্ত করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
একই বছরের জানুয়ারি থেকে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা। পিরোজপুর জেলায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮১ কোটি ২১ লাখ এবং পরের অর্থবছরে ৪৯৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। মোট আসে প্রায় ৫৮১ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে কাজ না করেই প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন ঠিকাদার মিরাজুল ইসলাম।
তিনি পিরোজপুর-২ আসনের সাবেক এমপি মহিউদ্দীন মহারাজের ভাই। এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, ১১৮টি রাস্তা সংস্কার ও প্রশস্ত করতে মিরাজুল ইসলামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুটি হচ্ছে ইফতি ইটিসিএল প্রাইভেট লিমিটেড ও সাউথ বাংলা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। দুদকের তদন্তে বের হয়েছে, ১১৮টি রাস্তার কোথাও কোনো সংস্কার বা প্রশস্তকরণের কাজ করা হয়নি। তবে কাজ হয়েছে বলে জাল কাগজপত্র তৈরি করা হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী-হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার যোগসাজশে।
পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার ৬০টি, পিরোজপুর সদর উপজেলার ৪৬টি, নাজিরপুরের ১০টি ও ইন্দুরকানি উপজেলার দুটি স্কিমের আওতায় এসব কাজ হওয়ার কথা ছিল। এসব স্থানে কাজ না করে আত্মসাৎ করা হয়েছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। এ ঘটনায় গত ১৬ এপ্রিল মিরাজুল ইসলামসহ এলজিইডি এবং হিসাবরক্ষণ অফিসের ১৪ জনের নামে মামলা করেছে দুদক। পিরোজপুর জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, এলজিইডির হিসাবরক্ষকসহ চারজনকে দুদক গ্রেপ্তার করেছে। অবশ্য মিরাজসহ মামলার অন্য ১০ আসামি পলাতক রয়েছেন।
মামলার বাদী পিরোজপুর দুদকের সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ঠিকাদার মিরাজুল ইসলাম প্রকল্পের ১১৮টি স্কিমের কাজ না করেই আসামিদের যোগসাজশে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পিরোজপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সাত্তার হাওলাদার, জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম এবং একই দপ্তরের হিসাবরক্ষক এ কে এম মোজাম্মেল হক খান ১১৮টি স্কিমের ভুয়া বিলের কাগজ তৈরি করেন। দুদকের অনুসন্ধানকারী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেখতে পান—এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তর থেকে পাঠানো সেই বিলের সঙ্গে দরপত্র, স্কিমের নম্বর, কার্যাদেশ, কাজের প্রত্যয়নপত্র, বিল অব কোয়ারি (বিওকিউ), কাজের পরিমাপ বইয়ের মতো অত্যাবশ্যকীয় কাগজপত্র ছিল না।
সেই কাগজ ছাড়াই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পিরোজপুর জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তারা বিল পরিশোধ করেন। গ্রেপ্তারের পর হিসাবরক্ষণ অফিসের একাধিক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার গ্রামের বাড়ি ভাণ্ডারিয়ায়। তিনি মুখ্য সচিব হিসেবে ২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে গত বছরের ৭ আগস্ট পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ঠিকাদার মিরাজুলের মুঠোফোনের মাধ্যমে মুখ্য সচিব বিল পাসের জন্য প্রায়ই নির্দেশ দিতেন। এ কারণে অসম্পূর্ণভাবে দাখিলকৃত বিল তাঁরা যাচাই-বাছাই না করেই পাস করিয়েছেন। মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ছাড় করাতে অন্য সরকারি দপ্তরের প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করার বিধান রয়েছে। সেই কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় অর্থ ছাড় করে থাকে। এই প্রকল্পের ক্ষেত্রেও পিরোজপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলীর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের কমিটি করা হয়েছিল। প্রকল্পের ১২৮টি স্কিমের কোনো কাজ পরিলক্ষিত হয়নি মর্মে সেই কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কমিটির এক সদস্য বলেন, কমিটির সদস্যরা সরেজমিনে ভাণ্ডারিয়া, পিরোজপুর সদরের নেছারাবাদে দৃশ্যমান কোনো কাজ দেখতে পাননি। এলজিইডি পিরোজপুর সদর উপজেলা প্রকৌশলী হরষিত সরকার বলেন, নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তর থেকে কার্যাদেশ প্রদানের কপি, পরিমাপ বই, ড্রয়িং, প্ল্যান ও অনুমোদিত প্রাক্কলনের ফটোকপি উপজেলা প্রকৌশলীর দপ্তরে পাঠানোর বিধান রয়েছে। কাজের গুণগত মান পরীক্ষার পাশাপাশি উপজেলা প্রকৌশলী ফাইল নোটের মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের পর বিলটি সুপারিশসহ নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরে পাঠাতে হয়। সে অনুযায়ী জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বিল প্রদান করেন। প্রকল্পের ১১৮টি স্কিমের ক্ষেত্রে এই ধাপগুলোর একটিও অনুসরণ করা হয়নি।