শাহাজাদা এমরান: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমীর ও শায়েখে চরমোনাই হযরত মাওলানা মুফতী ফয়জুল করীম (পীর সাহেব চরমোনাই) বলেছেন, এদেশে ইসলামী আইন চালু করতে হলে, কোরআন ও হাদিসের আলোকে দেশ শাসন করতে হলে, ইসলামী দলগুলোর ক্ষমতায় আসার কোন বিকল্প নেই। তাই সকল ভেদাভেদ ভুলে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীসহ দেশের সকল ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাতে অংশ নিতে পারে আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। আমাদের এই জোটে যদি কমিউনিষ্ট পার্টিও আসে তাহলেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। কারণ, আমরা কোরআনের আইন চালু করতে চাই। এই লক্ষ্যে যারা আসবে তাদের নিয়েই আমরা জোট করব। গত ১৮ জুলাই শুক্রবার বিকেলে বরিশাল জেলার সদর উপজেলার চরমোনাই ইউনিয়নের পীর সাহেব চরমোনাইয়ের দরবার শরীফে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে শায়েখে চরমোনাই চরমোনাই দরবার শরীফের ইতিহাস, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আলোচিত বিষয়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে তিনি খোলামেলা কথা বলেন।
কিভাবে চরমোনাই দরবার শরীফের যাত্রা শুরু হলো জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমীর ও শায়েখে চরমোনাই হযরত মাওলানা মুফতী ফয়জুল করীম (পীর সাহেব চরমোনাই) বলেছেন, আমার দাদা মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মদ ইসহাক (রহ.) (১৯১৫-১৯৭৭) ছিলেন বাংলাদেশের একজন পীর ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্ব। তিনি পীরসাহেব চরমোনাই নামে পরিচিত এবং চরমোনাইয়ের প্রথম পীর। তাঁর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় পীর হন তার সন্তান আমার আব্বা মাওলানা ফজলুল করীম সাহেব। আব্বার মৃত্যুর পর এখন দায়িত্ব পালন করছেন আমার ভাই। আমার দাদা হযরত মাওলানা মুফতী ইসহাক(রহ.) আমল থেকেই চরমোনাই দরবার শরীফের যাত্রা শুরু। আমরা বংশ পরম্পরায় দ্বীনের খেদমত করে আসছি। আল্লাহ তা'আলার রহমত নিয়ে আমরা এই দ্বীনের খেদমত করে আসছি। চরমোনাই দরবার শরীফে মসজিদ, মাদ্রাসা, কোরআন হাদিসের গবেষণাগারসহ স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। এই সবগুলো সম্ভব হয়েছে মানুষের ভালোবাসার কারণে। এখানে সরকারি কোনো অনুদান নেই। এমনকি এখানে বাংলাদেশের নামকরা কোনো ধনী ব্যক্তির অনুদানও নেই।
সম্প্রতি বরিশাল সিটির মেয়র পদ ফিরে পেতে আন্দোলনে নামছেন কিনা জানতে চাইলে মাওলানা মুফতী ফয়জুল করীম বলেন, বরিশাল সিটির সেই নির্বাচনে আমাকে জোরপূর্বক হারানো হয়েছে। বরিশালের সর্বস্তরের সাধারণ জনগণ আমাকে মেয়র করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবিতে ১৮ এপ্রিল শুক্রবার বরিশাল মহানগরীতে মানববন্ধন করেছে। সাধারণ নাগরিকের ব্যানারে এই মানববন্ধন হয়েছে। বরিশাল সিটি করপোরেশনের যে মেয়র নির্বাচন হয়েছিল, সেই নির্বাচনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিলাম তৎকালীন সময়ে। যেহেতু চট্রগ্রাম ও ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে আদালতের মাধ্যমে বিএনপির প্রার্থীরা মেয়র পদ ফিরে পেয়েছে, একই কারণতো বরিশাল সিটি নির্বাচনেও। তাই আমাদের বিশ্বাস, বরিশালের মানুষ মহামান্য আদালতের কাছে ন্যায় বিচার পাবেন।
যদি মেয়র পদ ফিরে পান তাহলে আপনার প্রথম কাজ কি হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আদালতের মাধ্যমে আমি যদি বরিশালের মেয়র নির্বাচিত হই, আমার সর্বপ্রথম কাজ থাকবে বরিশালবাসীকে নিরাপত্তা দেওয়া। সাধারণ মানুষ সর্ব জায়গায় জুলুমের শিকার। এই জুলুম থেকে তাদেরকে কিভাবে মুক্ত করা যায়, আমি সর্বপ্রথম সেই চেষ্টা করব। তাদের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করব। ভালো ভালো আইনগুলো প্রয়োগ করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল চাচ্ছে আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এই বিষয়ে আপনার দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের বক্তব্য কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা মনে করি, নির্বাচনই সব সমস্যার সমাধান নয়। আমাদের দেশে অনেক নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচন ডিসেম্বর হবে না জুনে হবে সেই তারিখ নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার কথা হলো, সংস্কারের বাইরে যদি নির্বাচন করা হয়, তাহলে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কিভাবে ঘটবে। প্রশাসনকে যদি ঢেলে না সাজানো হয় কিংবা সংস্কার না করে যদি নির্বাচন করা হয়, তাহলে সেটা হবে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন। ছাত্র আন্দোলনের সময় আমরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছি, যুদ্ধ করেছি। তাই আমরা সেই সময়ের কষ্টটা উপলব্ধি করি। যে কারণে ছাত্ররা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল, সেটা আমাদেরকে আগে বুঝতে হবে। তাই সংস্কারবিহীন নির্বাচন করা যথোপযুক্ত হবে না।
বিএনপিকে এ দেশের মানুষ অনেকবার ক্ষমতায় দেখেছে। তাদের কথা এবং কাজে কেমন মিল রয়েছে, আমরা সবাই জানি এবং এ দেশের মানুষ সেটা জানে। ওইটা বাদ দিন, পাঁচ আগস্টের যে বিপ্লব হয়েছে, সেটা নিয়ে বিএনপির একেক নেতা একেক রকমের বক্তব্য দেন। তারা এখনো নিজের দল এবং নিজের নেতাকর্মীদের সংশোধন করতে পারেনি। যে দলের, দলের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই, তারা দেশের নিয়ন্ত্রণ নেবে কিভাবে? তারা যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে সর্বোচ্চ দুই বছর থাকতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে।
একটি অনির্বাচিত সরকার বেশি দিন ক্ষমতায় থাকলে নানা রকম সমস্যা হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে এই প্রসঙ্গে শায়েখে চরমোনাই বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে অনির্বাচিত সরকার বলা যাবে না। কারণ তিনি সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ও জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। সুপ্রিম কোর্ট ওনার এই ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট আর জনগণ এর উপর আর কোনো রায় আছে বলেন?
এক সময় জামায়াতের সাথে আপনাদের আদর্শিক বিরোধ ছিল। এখন আবার শোনা যাচ্ছে আপনারা জামায়াতের সাথে জোট করতে চাচ্ছেন বিষয়টি পরিস্কার করবেন কি না এই প্রসঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমীর বলেন, নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতের আগের বক্তব্য আর এখনকার বক্তব্য এক নয়, আপনারা একটু খেয়াল করে দেখবেন। আমরা আগামীতে চাইছি ইসলামী যে দলগুলো রয়েছে, সেগুলো একটি জোট হয়ে নির্বাচন করুক। শুধু ইসলামী দল নয়, আমাদের এই জোটে চাইলে কমিউনিস্ট পার্টিও আসতে পারেন। ইসলাম, দেশ এবং মানবতার জন্য আমরা কাজ করব। যদি আমাদের মধ্যে মৌলিক সমর্থন তৈরি হয়ে যায়, তাহলে নির্বাচনের মাঠে এটা কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না। ইসলাম মানেই শান্তি, ইসলাম মানেই মুক্তি। মানুষ চায় ইসলামের সংবিধান অনুযায়ী দেশ চলুক। কিন্তু ব্রিটিশরা আমাদের বর্তমান প্রজন্মের মাথায় বিভিন্ন ইহুদি-নাসারা এবং খ্রিস্টানদের কিছু বিষয় ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। একজন মুসলিম যদি নবী এবং নবীর সুন্নাহ বোঝে, তাহলে সে আর অন্য ধর্মের কোনো কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হবে না। সে ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করবে। সুতরাং এই মুহুর্তে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে আমরা কোন বিরোধ চাই না। জামায়াতসহ দেশের সকল ইসলামী দলগুলো একটি জোটের মাধ্যমে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসার চেষ্টা করছে। আমরা সেই লক্ষেই কাজ করছি।
আমাদের প্রতিবেশী ভারত এখনো আওয়ামীলীগ সরকারের পতন মেনে নিতে পারছে না- বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি বলব, আমাদের দেশ ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে নয় বরং ভারতের গোলাম হিসেবে ছিল গত ১৬ বছর। আমরা ছিলাম ভারতের চৌকিদার। শেখ হাসিনার কারণে সেভেন সিস্টার্সের চৌকিদারি করতাম আমরা। হঠাৎ করে ভারত দেখল যে তাদের চৌকিদার মালিক হতে চায়। তারা কর্তৃত্ব করতে চায়। তাই ভারত আমাদের উপর এখন ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তারা এ দেশের মিডিয়ার প্রশিক্ষণ দেয়। সাংবাদিক সাপ্লাই দেয় ভারত।কিন্তু যখনি ড. ইউনুস সাহেব মাথা তুলে দাঁড়াতে চেষ্টা করছেন তখনি তাদের গায়ে গরমের তাপ লাগা শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ ভারতকে প্রভু নয়, বন্ধু হিসেবে দেখতে চায়।
জুলাই বিপ্লবের সফলতা নিয়ে জানতে চাইলে শায়েখে চরমোনাই মুফতী ফয়জুল করীম বলেন, যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জুলাই বিপ্লব হয়েছে, সবাই যেন সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে সম্মিলিতভাবে কাজ করে এই আশা থাকবে।