জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ নিয়মিত ফোন করে শিশুরাও। এবার ঈদের ছুটিতে (২৮ মার্চ-৫ এপ্রিল) প্রায় সাড়ে সাত হাজার সেবাযোগ্য ফোন করেছে তারা। পারিবারিক নির্যাতন, আশপাশে মারামারি, উচ্চশব্দে গান বাজানো, পড়াশোনায় চাপ দেওয়া ও বাবা-মায়ের অতিরিক্ত শাসনের কারণেও ফোন করে অনেক শিশু।
বড়দের মতো শিশুদের ফোনও সমান গুরুত্বের সঙ্গে নেয় ৯৯৯। অভিযোগ যদি শিশুদের নিজেদের হয় তাহলে পুলিশ গিয়ে সেই শিশুসহ তার পরিবারকে বুঝিয়ে আসে। পরিবারের অন্য সদস্যদের বিপদ-আপদ হলে সেটার সমাধানের চেষ্টা করে। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপদ-আপদ বা নিজেদের কোনো সমস্যার কথা জানিয়ে শিশুদের পুলিশকে ফোন করা প্রথা চালু আছে। আমাদের দেশেও এটা বাড়ছে।
ঈদের তৃতীয় দিন রাত ৯টার দিকে নীলফামারীর ডোমার থানা এলাকা থেকে তাকওয়া হাবীব তাসিন (ছদ্মনাম) নামের আট বছর বয়সী এক শিশু ৯৯৯- এ ফোন করে। শিশুটি ফোন করে জানায়, সে ঈদের ছুটিতে আছে, এই সময়ে তার মা তাকে পড়তে বলেছে। ফোন পেয়ে প্রথমে ৯৯৯ থেকে শিশুটিকে আশ্বস্ত করে পুলিশ। এরপর স্থানীয় থানা পুলিশ শিশুটির বাসায় যায়। ওই শিশুটির পরিবারকে পুলিশ গিয়ে বুঝিয়ে আসে।
৯৯৯ এ দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা বলছেন, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু। এই হিসেবে ১৮ বছরের নিচে যারা ৯৯৯-এ ফোন করে তাদের চাইল্ড এনকোয়ারি কল বা শিশু কল হিসেবে গণ্য করা হয়। শুধু ঈদের সময় নয়, গত কয়েক বছর অন্য সময়েও শিশুরা ফোন করছে। বিশেষ করে পরীক্ষার আগে যখন বাবা-মা পড়ার জন্য চাপ দেয় বা বকাঝকা করে তখন ফোন করে। আবার পরীক্ষার আগে কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকার কথা থাকলেও বন্ধ না হলে এ বিষয়েও ফোন করে অনেক শিশু শিক্ষার্থী তথ্য দেয়।
তবে ফ্রি কলের সুযোগ থাকায় অনেক শিশু ৯৯৯-এ ফোন করে বকাঝকা করে, গান শোনায় এমনকি মিসড কলও দেয়। এগুলো চলে যায় ভুয়া কলের হিসাবে।
বাবা-মা অতিরিক্ত শাসনের জন্য ৯৯৯-এ ফোন করে অনেক শিশু। বিশেষ করে বার্ষিক পরীক্ষার আগে ফোনকলগুলো বেশি আসে। পাশাপাশি পাবলিক পরীক্ষার আগে কোচিং সেন্টার খোলা প্রসঙ্গে পুলিশের সহায়তা চেয়ে ফোন করে অনেক শিশু শিক্ষার্থী।- জাতীয় জরুরি সেবার পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার
২০২৩ সালের ২১ এপ্রিল মায়ের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করে আট বছর বয়সী এক শিশু। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিশুটির মাকে আটক করে পুলিশ।
অভিযোগকারী মিরপুর ৬০ ফুট এলাকার নলেজ হেভেন নামে একটি কিন্ডারগার্টেনের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে তখন জানায়, তার বাবা-মায়ের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হয়। সে ঝগড়ার রেশ ধরে তার মা শুধু তাকে মারধর করেন।
শিশু তামিম আরও জানায়, তার বাবা তাকে বলেছে কখনো কোনো বিপদে পড়লে ৯৯৯-এ ফোন করতে। ফোন করলে পুলিশ আসে। সে কথা অনুযায়ীই সে ৯৯৯-এ ফোন করে।
৯৯৯ সূত্র জানায়, ঈদে ৯ দিনের ছুটির মধ্যে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ফোন করে সাত হাজার ৫৫৫ জন শিশু। এর মধ্যে ছুটির শুরুর দিন ২৮ মার্চ ফোন করে ৮৩০ শিশু, ২৯ মার্চ ৯৩০, ৩০ মার্চ ৭৭১, ঈদের দিন ৩১ মার্চ ফোন করে ৭১২ শিশু, ১ এপ্রিল ৭৫৭, ২ এপ্রিল ৮৫৩, ৩ এপ্রিল ৯২৩, ৪ এপ্রিল ৯৩০ শিশু এবং ৫ এপ্রিল ফোন করে ৮৪৯ জন শিশু। সারাদেশ থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮৩৯ জন শিশু কল করে ৯৯৯-এ।
জাতীয় জরুরি সেবা থেকে পাওয়া কলের তালিকা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
১০টি প্রধান সমস্যার তথ্য জানিয়ে ঈদের ছুটির নয়দিনে মোট কল আসে দুই লাখ ৪০ হাজার ৬৯৩টি। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মারামারি সংক্রান্ত কারণে ফোন আসে ৩৭৬৮টি, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ফোনকল আসে শব্দদূষণের প্রতিকার চেয়ে ১২৩৩টি। এছাড়া অগ্নিকাণ্ড সংক্রান্ত কল ১২২২টি, জরুরি চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত কল ৯৪৪টি, অবরুদ্ধ বা জোর করে আটকে রাখা সংক্রান্ত কল ৯০৩টি, সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে কল ৭৭৮টি, নারী নির্যাতনের প্রতিকার রোধে কল ৭৩৭টি, ঈদে বাড়ি ফেরা ও দুর্ঘটনা সংক্রান্ত কল ৫৭১টি, ঈদে চুরি সংক্রান্ত কল ৫৩৩টি এবং ঈদে জমাজমি দখল সংক্রান্ত ৫০০টি কল পায় জাতীয় জরুরি সেবা।
ঈদের ছুটিতে নারীরাও বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে ফোন করেছেন ৯৯৯-এ। তবে শিশুদের কলের চেয়ে নারীদের কলের সংখ্যা ছিল কম। ৯ দিনে নারীদের মোট ফোনকলের সংখ্যা ১৫শ ৬০টি।
এর মধ্যে ছুটির শুরুর দিন ২৮ মার্চ ফোন করেন ১৬৫ জন নারী, ২৯ মার্চ ২১৮, ৩০ মার্চ ১৩৮, ঈদের দিন ৩১ মার্চ ১৩৬, ১ এপ্রিল ১৬৮, ২ এপ্রিল ২২১, ৩ এপ্রিল ১৭৭, ৪ এপ্রিল ১৭২ এবং ৫ এপ্রিল ফোন করেন ১৬৫ জন নারী।
নারীদের ফোনকলের সংখ্যা কম হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৯৯৯-এর একজন নারী কল টেকার জানান, স্বামী ও পরিবারের ভয়ে অনেক সময় নির্যাতনের শিকার নারীরা ফোন করতে চান না। যারা ফোন করেন তাদের নিয়ম অনুযায়ী সেবা দেওয়া হয়।
ভুয়া কল লাখের বেশি
৯৯৯-এ মানুষ মূলত সেবা নেওয়ার জন্যই ফোন করেন। তবে একদল দুষ্টু লোক এখনো ৯৯৯-এ মিসড কল কিংবা হাসি-তামাশার জন্য কল করেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কাজ করছে পুলিশ। এবার ঈদে এমন কলের সংখ্যাও কম নয়। অনেক সময় কল করে অপর প্রান্ত থেকে কথা বলা হয় না, গান শোনানো হয় কিংবা হাসি-তামাশা করা হয়। ঈদের ছুটিতে এমন ফোনকলের সংখ্যা এক লাখ ১৮ হাজার ৪১৬টি।
জাতীয় জরুরি সেবার পরিদর্শক (ট্রেইনার, ফোকাল পারসন অ্যান্ড পাবলিক রিলেসন্স) আনোয়ার সাত্তার বলেন, ‘পারিবারিক অনেক সমস্যা ও সহিংসতার কারণে শিশুরা ৯৯৯-এ ফোন করে নিয়মিত। বাবা-মা অতিরিক্ত শাসনের জন্য ৯৯৯-এ ফোন করে অনেক শিশু। বিশেষ করে বার্ষিক পরীক্ষার আগে ফোনকলগুলো বেশি আসে। পাশাপাশি পাবলিক পরীক্ষার আগে কোচিং সেন্টার খোলা প্রসঙ্গে পুলিশের সহায়তা চেয়ে ফোন করে অনেক শিশু শিক্ষার্থী।’
তিনি বলেন, ‘শিশুরা ৯৯৯-এ ফোন করে যেমন সেবা নিচ্ছে তেমন ভুয়া কলও করছে। অনেক সময় মজা নেয়, বাজে কথা বলে, গালাগালি করে ফোন করে। একসঙ্গে ৯৯৯-এর ফোনকল লিমিট ৮০টি। এর মধ্যে যদি ৮-১০টি কল লাইনে থাকে তবে সত্যিকারের বিপদ্গ্রস্ত মানুষের সেবা পেতে বিলম্ব হয়।’
যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে টেলিফোন করে বিরক্ত করলে তার শাস্তির বিধান রয়েছে আইনে। এ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়ার কথা বলা আছে।
জানা যায়, ২০২১ সালের ১ জুলাই বিরক্ত করা কলের জন্য দণ্ডের বিধান রেখে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০১ এর ধারা ৭০ (১) সংশোধন করা হয়। এই আইনে যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কল দিলে এক লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড হতে পারে। এমনকি মোবাইল কোর্টের মাধ্যমেও বিরক্তিকর কলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।