প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আচরণ বিষয়ে কিছু সুস্পষ্ট বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই বাধ্যবাধকতাসমূহ আইন ও বিধি দ্বারা পরিচালিত। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীগণের শৃঙ্খলা, সেবা দেওয়ার বিধান, অনুসরণীয় রীতি ইত্যাদি বিষয়গুলোসরকারী কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯, সরকারি চাকরি আইন ২০১৮, সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮, সরকারী প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা, ২০১৯ সহ মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিভিন্ন নির্দেশিত পত্র, পরিপত্র ও বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। একজন সরকারি কর্মচারী তার সামগ্রিক কর্মজীবনে এই চাকরিবিধিসমূহ মেনে চলতে বাধ্য। সরকারি চাকরিতে যোগদানের পরেই একজন কর্মচারী এই বিধিসমূহের আওতায় চলে আসেন। এর ব্যত্যয় ঘটানোর সুযোগ নেই।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখ আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ নামক সিভিল সার্ভেন্টদের একটি সংগঠন অর্ধদিবস কর্মবিরতি কর্মসূচীর একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এই সংগঠন মূলত প্রশাসন ক্যাডার ব্যাতীত বাকি ২৫টি ক্যাডারের কিছু সদস্য নিয়ে গঠিত। সম্প্রতি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার আগে এবং পরে এই সংগঠনটি কমিশনের রিপোর্ট/প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রমাগত বিবৃতি/স্ট্যাটাস/পোস্ট দিয়ে আসছিলো।এরই ধারাবাহিকতায় তারা আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। তাদের দ্বন্দ্ব মূলত প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যগণের সাথে। ফলশ্রুতিতে, এদের অনেকেই আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে তাদের স্ব স্ব মন্ত্রণালয় তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়।
কিন্তু আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ নামক সংগঠনটি এসবের পরেও থেমে থাকেনি। তারা তাদের সাম্প্রতিক প্রেস রিলিজের মাধ্যমে জানিয়েছে তাদের ‘দাবী’ মেনে নেওয়া না হলে তারা আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার অর্ধদিবস এবং ২ মার্চ রবিবার পূর্ণ দিবস কর্মবিরতিতে যাবে।
এখন প্রশ্ন হলো, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে তারা এরূপ কর্মবিরতি দিতে পারেন কী না। সরকারী কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ এর বিধি ২৩-এ বলা হয়েছে সরকারি কর্মচারীরা এমন কোনো মতামত বা বিবৃতি প্রকাশ করতে পারবেনা যা সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলে। একই বিধিমালার বিধি ৩০এ তে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের বা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত বা আদেশ পালনে জনসম্মুখে আপত্তি উত্থাপন করতে পারবেনা এবং কোনো ব্যক্তিকে তা করার জন্য উত্তেজিত বা প্ররোচিত করতে পারবেনা;একইসাথে সরকারের কোনো আদেশ পরিবর্তন বা সংশোধনের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারবেনা।
অথচ আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ নামক সংগঠনটি এবং এর সদস্যগণ ক্রমাগত আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে আসছে। গত ৫ অক্টোবর আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের ব্যানারে ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্যদের প্রত্যাখান করে যা সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে জনসম্মুখে আপত্তি উথাপন করার শামিল। পরবর্তীতে ১৯ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ ঢাকাস্থ খামার বাড়ির তুলা ভবনে মতবিনিময় সভা করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে প্রত্যাখানের ঘোষণা দেয়। অতঃপর, ১৬ই নভেম্বর ২০২৪ তারিখে রাজশাহীতে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের বিভাগীয় সম্মেলনে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে পক্ষপাতদুষ্ট সংস্কার কমিশন দাবি করে এর পুনর্গঠনের দাবি জানান ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা।গত ১৭ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এক সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী ঘোষণা দেন যে তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে ক্যাডারের বাইরে রাখার প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছেন। পাশাপাশি উপসচিব পদে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৫০% এবং বাকি ক্যাডার থেকে ৫০% কর্মকর্তা নিয়ে পদোন্নতির প্রস্তাব দেওয়ার সুপারিশ চূড়ান্ত করেছেন। মূলত এই ঘোষণার পর থেকেই পরিস্থিতি উত্তপত হয়ে ওঠে।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ২১ ডিসেম্বর ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা আন্দোলনের ঘোষণা দেয় সরকারি কর্মচারি হিসেবে যা নজিরবিহীন। ২২শে ডিসেম্বর প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সচিবালয়ে জমায়েত করে এবং বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের সভাপতির নেতৃত্বে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের নিকট তাদের দাবি তুলে ধরেন। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্ত্যব্য পালটা মন্তব্যের বাকযুদ্ধ চলতে থাকে। ২২শে ডিসেম্বর ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রশাসন ক্যাডারকে বাইরে রেখে উপসচিব ও তদুর্ধ্ব পর্যায়ের ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়ে নতুন সংগঠন ‘এসোসিয়েশন অফ সিনিয়র পুল সার্ভিস গঠন’ করে যা আন্তঃক্যাডার সংঘাত সৃষ্টির চূড়ান্ত পদক্ষেপ। ২৩শে ডিসেম্বর বিসিএস হেলথ ক্যাডার এসোসিয়েশন এর কর্মকর্তারা হেলথ ক্যাডার বিলুপ্ত সংক্রান্ত সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে বলে স্বাস্থ্য ক্যাডার না থাকলে কোন ক্যাডার থাকবে না এমন হুমকি প্রদান করে।
২৪ ডিসেম্বর ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা সকাল ১১টা থেকে ১২টা নজিরবিহীন কলম বিরতি কার্যক্রম পালন করে। ২৫ ডিসেম্বর প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বিয়াম ফাউন্ডেশনে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন ও বিসিএস প্রশাসন বহুমুখী সমবায় সমিতির অধীনে একটি প্রতিবাদ সভা আয়োজন করেন যেখানে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত উভয় শ্রেনীর কর্মকর্তাই বক্তব্য রাখেন। বক্তাদের মধ্যে বিসিএস প্রশাসন বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি ও বিএনপি চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব জনাব আবদুস সাত্তার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান মুয়ীদ চৌধুরীর পদত্যাগ দাবি করেন। ২৫শে ডিসেম্বর ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা সারা দেশে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে যা ইতিহাসে নজিরবিহীন।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীগণ কোনো ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য নন যে দাবী দাওয়া আদায়ে তারা এরূপ কর্মবিরতিতে যেতে পারেন বা আচরণবিধি লঙ্ঘন করতে পারেন। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, অতি সম্প্রতি শিক্ষা ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা (মুকিব মিয়া) পতিত স্বৈরাচারের পক্ষে লিফলেট বিতরণও করেছেন।
সামগ্রিক ঘটনাগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা ধারাবাহিকভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে আসছেন। সরকারের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে এই আচরণগুলো আদৌ দাবী আদায়ের জন্য নাকি সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য। কারণ পতিত স্বৈরাচারের অনেক ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’ এখনও সিভিল সার্ভেন্টদের মাঝে বিরাজমান। তারা যেকোনোভাবে চাইবে অন্তর্বর্তী সরকার যেনো ব্যার্থ হয়। এভাবে চলতে থাকলে সরকারের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে এবং সরকারি সেবার মান যে কমে যাবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।