ঢাকা
৫ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
রাত ২:২৮
logo
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪

আত্মগোপনে আওয়ামী লীগ, মাঠ প্রস্তুত করছে বিএনপি

পদ্মা সেতু থেকে ২০ কিলোমিটার দূরত্ব। মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলা। কৃষি প্রধান অঞ্চল এটি। বারো মাসেই বিভিন্ন ফসল হয়। চলতি মৌসুমে ধনিয়া, কালাই, সরিষা, মসুর, পিয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন ফসল বুনছেন কৃষক। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর থেকে শুরু হয় তাদের ব্যস্ততা। ঘরে ফেরেন সন্ধ্যায়। তিন-চার মাস অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও কৃষক পান না ফসলের উপযুক্ত দাম। এই কৃষকদের একজন নুরু ঢালি। জাদুয়ার চর গ্রামের বাসিন্দা। ছোটবেলা থেকেই হালচাষ করেন। বয়স এখন ৬৪ বছর। বুধবার সকালে এক খণ্ড জমিতে আগাছা পরিষ্কার করছিলেন তিনি। নুরু ঢালি বলেন, কয়েক মাসের ব্যবধানে ফসলের সার-ওষুধের দাম অনেক বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছে। এতে ফসল ফলাতে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘তিন-চার মাস আগে ১১০০ টাকা বস্তা ছিল সারের দাম। আর ৫ দিন আগে কিনছি ১৫০০ টাকা বস্তা।

নুরু ঢালির টানাপড়েনের সংসার। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস বাড়ছে। বাসায় আত্মীয়রা না আসলে ৬ মাসেও একদিন গরুর মাংস কিনে খাওয়া হয় না। নুরু ঢালি বলেন, ‘বাসায় মেহমান আইলে মাংস আনা হয়। এই সরকারের সময়ও সবকিছুর দাম বেশি। কয়দিন আগেও এক বোতল (পাঁচ লিটার) তেল কিনছিলাম ৮১০ টাকা দিয়া, এখন ৮৭০ টাকা। তেলের দাম বাড়লো কেমনে। এটা কারা বাড়ায়। এটা বলার কেউ নাই।’

বিগত ৩০-৩৫ বছর ধরেই মাদারীপুর শাসন করেছে আওয়ামী লীগ। তিনটি আসনের মধ্যে মাদারীপুর ১ ও ২ আসনে টানা ৬ বারের এমপি ছিলেন নূর-ই-আলম চৌধুরী ও শাহজাহান খান। এমপি পরিবর্তন হলেও ১৯৯৬ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত মাদারীপুর ৩ আসনটিও আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এসব আমলে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেট, জমিদখল, দমন, নির্যাতন, হামলা-মামলা সবই করেছে তারা। দলটির নেতাকর্মীদের কাছে জিম্মি ছিল মাদারীপুরবাসী।

রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক যেকোনো সভা-সমাবেশ করতেও নিতে হতো তাদের অনুমতি। এসব হিসাবনিকাশ পাল্টেছে হাসিনা সরকার পতনের পর। এখন পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা। অনেকে পাড়ি দিয়েছেন বিদেশে। কেউ গা ঢাকা দিয়ে আছেন। বিপরীতে মাঠে সরব হয়েছে বিএনপি। নিয়মিতই সভা-সমাবেশ, শোডাউন করছে দলটি। উজ্জীবিত করছে দলের নেতাকর্মীদের। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামী কিংবা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও এখন মাদারীপুরে সরব।

বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল করছেন তারা। শিবচরের স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত ৫ই আগস্টের পর বিএনপি বেশ তৎপর। বিশেষ করে বিএনপি’র নাম ভাঙিয়ে কেউ যেন চাঁদাবাজি না করে এজন্য এলাকায় মাইকিং করা হয়। কেউ চাঁদাবাজি করলে সেনাবাহিনীকে খবর দেয়ার কথাও বলা হয়। এ ছাড়া শোক ও প্রতিবাদ সভা, যুবদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, লিফলেট বিতরণ, নেতাকর্মীদের নিয়ে মিলনমেলাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কার্যক্রম করেছে তারা। আবু সাইদ নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, গ্রামে এখন আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী নাই। ওই আমলে যারা অপকর্ম করেছে সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বিএনপি’র লোকজন এখন আছে। ঢাকা থেকেও অনেকে গ্রামে এসে বিএনপি’র রাজনীতি করছে।

বিএনপি ছাত্রদের নিয়ে মতবিনিময়ও করেছে। গত ৩ মাসে বিএনপি-জামায়াত-ছাত্র সবাই সক্রিয় ছিল। স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষক মো. ইউনুস বলেন, আওয়ামী লীগ যারা আছে সবাই এখন নীরব। ঘর থেকে বাজারেও বের হচ্ছেন না ঠিকমতো। তবে তাদের কেউ বাধাও দিচ্ছে না। মাঠে এখন বিএনপি সক্রিয়। বিভিন্ন সমাবেশ করছে তারা। শিবচরের বাহাদুরপুর বাজারে চায়ের দোকান সুমনের। দোকানটিতে নানা মতাদর্শের লোকজন চা খেতে আসেন। সুমন জানিয়েছেন, তাদের গ্রাম এখন নীরব। সেখানে বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী থাকলেও এখন তারা কেউ নাই। অধিকাংশই ৫ই আগস্টে পালিয়েছে। কেউ আবার মামলা হওয়ার পর পালিয়েছে। শফিক মুন্সী নামের এক কৃষক বলেন, মাঝেমধ্যে বিএনপি’র মিটিং দেখি।

ঢাকা থেকেও লোক এসে মিটিং করে। রাস্তা দিয়া মিছিল নিয়া যায়। কাশেম ব্যাপারি নামের এক ভ্যানচালক বলেন, ৫ই আগস্ট আন্দোলনের সময় ভাঙচুর হইছিলো। কিন্তু তারপর আর হয় নাই। এখন শুধু মানুষ চুরির ভয়ে আছে। কখন কার ঘরে চুরি হয়। কিন্তু কোনো মারামারি নাই। সবাই মিলেমিশে আছে।

বিএনপি’র নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, দলকে গুছিয়ে রাখতে তারা এলাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান করছেন। জনসম্পৃক্ততা তৈরির চেষ্টা করছেন। তবে আগের সরকারের আমলে তা করার কোনো সুযোগ ছিল না। শিবচর পৌরসভার বিএনপি’র আহ্বায়ক হেমায়েত খান বলেন, আগে মাদারীপুরে একনায়কতন্ত্র ছিল। ফ্যাসিস্টরা মানুষকে নির্যাতন করেছে।

অর্থ আত্মসাৎ করেছে। নেতা থেকে মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা পর্যন্ত লুটপাট করেছে। আমরা কাজকর্ম করেও খেতে পারতাম না এলাকায়। ৫ই আগস্টের পর নতুন বাংলাদেশ পেয়েছে মাদারীপুরের মানুষ। এখন সবাই চায়, দেশে যত দ্রুত সম্ভব একটা নির্বাচন। তিনি বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন বিশ্ব নন্দিত মানুষ। কিন্তু বর্তমান সরকারের জনসমর্থন নাই, লোকবল নাই। ৫ই আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুর্বল হয়ে আছে। এখনো ঠিক হয় নাই। থানায় অভিযোগ দিলে কার্যকর পদক্ষেপ নেয় না। এজন্য দেশে একটা শ্রেণি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই লুটপাট করছে। এগুলো দূর করতে হলে জনপ্রতিনিধিদের হাতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দিতে হবে। গ্রামের মানুষ সংস্কার বোঝে না। তারা বোঝে চাল-ডাল-তেলের দাম কীভাবে কমবে। এই সরকার এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে নির্বাচিত সরকার দরকার।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও মানুষের আক্ষেপ রয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে। তেল, আলু, পিয়াজের দাম চড়া। শীত চলে আসলেও সবজির দাম তেমন কমেনি। এতে নাভিশ্বাস নিম্ন আয় ও কৃষক শ্রেণির মানুষের। এ ছাড়া কয়েক-মাস ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যও শ্লথ হয়েছে। ব্যাংক থেকেও চাহিদা মাফিক টাকা তুলতে পারছেন না বলেও অভিযোগ করেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, মানুষের পকেটে টাকা নেই। ব্যাংকে গেলে সব টাকা দিতে চায় না। অনিশ্চয়তার কারণে মানুষ এখন খরচ কমিয়েছেন। সংসারের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাচ্ছেন কাটছাঁট করে। শিবচরের বাহাদুরপুর বাজারের একটি হোটেলের স্বত্বাধিকারী আলমগীর ফরাজি। কয়েক মাসে তার হোটেলের আয় কমেছে। আলমগীর বলেন, গত মাসে ৫৪ হাজার টাকা ক্ষতি হইছে দোকান করে। এলাকায় মানুষ এখন বাজারে কম আসছে। জিনিসপত্রের অনেক দাম। আমাদের খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু সে অনুযায়ী ব্যবসা নেই। দেশে টাকা নাই। মানুষের কাছে টাকা নাই। মানুষ খাইবো কেমনে। আলুর দাম ৭০ টাকা, পিয়াজ ৯০ টাকা। শীতের সবজি আসছে বাজারে। কিন্তু এখনো সেভাবে দাম কমে নাই। আরেক ব্যবসায়ী বলেন, গত ২-৩ মাস ধরে ব্যবসা খারাপ। মানুষের কাছে টাকা নাই। বাজার পরিস্থিতি খারাপ। এক কেজি আলু কিনতে লাগে ৭০ টাকা। বাজারে তেল পাওয়া যায় না। তেলের দাম আবারো বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করতাছে। এই সরকার হইলো অন্তর্বর্তী সরকার। সিন্ডিকেটরা তার কথা শুনতে চাইবো না।

খানকান্দি সৈয়দ আশরাফ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক জাহির হোসেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান তিনি। বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে গ্রামের মানুষ কষ্টে আছে। অনেকের স্কুলের বেতন দিতে কষ্ট হয়। আমাদের কাছে আবেদন করলে মওকুফ করে দেই। এই পরিস্থিতিতে মানুষ নির্বাচিত সরকার চায়। এভাবে থাকতে চায় না। সিন্ডিকেট ভাঙতে পারবে নির্বাচিত সরকার। সেটা যত তাড়াতাড়ি হবে তত ভালো। শিবচর বাজারে নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসা করেন আসিফ আহমেদ। তিনি বলেন, ক্রেতার চাহিদা কমে গেছে। শেখপুর বাজারে অটো চালান নাজিম। দিনে তার ৫০০-৬০০ টাকা আয়। দিন দিন এই আয় আরও কমছে। নাজিম বলেন, রাস্তায় অটো বেড়ে গেছে। যাত্রী কম। ভালো ইনকাম হয় না। যা হয় তা দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। ১০০ টাকার নিচে কোনো সবজি নাই। তিনি বলেন, সন্তান নিয়ে কষ্ট করে চলি। মাংসের বদলে মাছ খাই, মাছ খাওয়ার টাকা না হলে ডাল দিয়ে ভাত খাই। এভাবেই চলি।

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram