ঢাকা
২৮শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
রাত ৮:৩৩
logo
প্রকাশিত : জুন ২৮, ২০২৫

মনোনয়ন ও কমিটি বাণিজ্যে হাতিয়েছেন হাজার কোটি

ওবায়দুল কাদের ১০ বছরের বেশি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার এক অনন্য রেকর্ড অর্জন করেন তিনি। পাশাপাশি ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগের মন্ত্রী। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে তিনি যেমন লুটেপুটে খেয়েছেন, তেমন দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর টাকার বিনিময়ে কমিটি গঠন, মনোনয়ন বাণিজ্য করে কামিয়েছেন হাজার কোটি টাকা।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত হিসাব কষে দেখা গেছে, এসব কমিটি এবং মনোনয়ন থেকে ওবায়দুল কাদের অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কমিটি গঠনে তাঁর ছিল একক এখতিয়ার। কমিটি করে তিনি শুধু শেখ হাসিনার কাছ থেকে একটি মৌখিক সম্মতি আদায় করতেন। আর এ কমিটি গঠনের মাধ্যমে দুই হাতে টাকা কামিয়েছেন আওয়ামী লীগের এই বিতর্কিত সাধারণ সম্পাদক, দলেই যাকে সবাই ডাকে ‘কাউয়া কাদের’ নামে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, একটি ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটি থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত সর্বত্র চলত টাকার খেলা। সেখানে দলের নেতা-কর্মীদের যোগ্যতা বিচার করা হতো না। ওয়ার্ড পর্যায়ের একটি কমিটি হওয়ার জন্য নির্ধারিত মূল্য ছিল অন্তত ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। যদি ওয়ার্ড পর্যায়ে বড় ধরনের নেতা হতে চায়, যেমন ওয়ার্ড সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক তাহলে অন্তত ২০ লাখ টাকা তাঁকে দিতে হতো। থানা পর্যায়ে কমিটির জন্য ১৫ থেকে ২০ লাখ পর্যন্ত দিতে হতো একজনকে। আর জেলা পর্যায়ের কমিটির জন্য ছিল ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত।

আর এটি যদি মহানগরের কমিটি হয় তাহলে তার ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত নির্ধারিত ছিল। ১০ বছরে আওয়ামী লীগের জেলা, উপজেলা পর্যায়ে যত কমিটি হয়েছে তার সবকিছু টাকার বিনিময়ে হয়েছে। এ টাকাগুলো আসত অভিনব পন্থায়। আওয়ামী লীগের আটজন সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। আটজন সাংগঠনিক সম্পাদককে আট বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা যে কোনো কমিটির জন্য প্রথমে নিলামের মতো করে টাকা দাবি করতেন। কে কত টাকা দিতে পারবেন। যাঁরা সর্বোচ্চ টাকা দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হতেন তাঁদের নাম সাংগঠনিক সম্পাদকরা দিতেন ওবায়দুল কাদেরের কাছে। এরপর ওবায়দুল কাদের তাঁদের কমিটির জন্য কত টাকা পাচ্ছেন তাঁর হিসাবনিকাশ ইত্যাদি যাচাইবাছাই করতেন। তিনি কোনো দিনই দেখতেন না ওই কর্মী আসলেই আওয়ামী লীগ করেন কি না কিংবা কমিটিতে থাকার মতো তাঁর যোগ্যতা আছে কি না। বরং টাকার অঙ্কে কে বেশি হলেন সেটাই তাঁর বিবেচ্য বিষয় ছিল।

যাঁরা কমিটির জন্য সর্বোচ্চ টাকা দিতেন তাঁদের কমিটি ওবায়দুল কাদের পাশ করে দিতেন। টাকার লেনদেন হয়নি জন্যই ঢাকা উত্তর-দক্ষিণের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেননি ওবায়দুল কাদের। এ রকম বহু জায়গায় আছে যেখানে কমিটির জন্য যে নির্ধারিত মূল্য ধরা হয়েছিল, সেই মূল্য দিতে অস্বীকৃতি জানানোর জন্য ওবায়দুল কাদের কমিটি করেননি। ফলে সব কমিটিতেই জায়গা পেয়েছেন লুটেরা দুর্বৃত্তরা। যাঁরা এ কমিটির পরিচয় ব্যবহার করে ইচ্ছেমতো লুটপাট করেছেন। আমরা ফরিদপুরের বরকত-রুবেলের কথা যেমন জানি, ঠিক সে রকমভাবে ঢাকায়ও আওয়ামী লীগের কমিটির সদস্য হাজার কোটি টাকা লুটপাটের খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কোনো কোনো থানা বা জেলায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য লুটেরা মন্ত্রী-এমপিরা কমিটির জন্য টাকা দিতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লোটাস কামাল তাঁর পুরো নির্বাচনি এলাকার সব কমিটির জন্য ওবায়দুল কাদেরকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা এককালীন দিয়েছিলেন।

সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী এ বি এম তাজুল ইসলাম তাঁর নির্বাচনি এলাকায় কমিটির জন্য ওবায়দুল কাদেরকে ১০০ কোটি টাকা দিয়েছিলেন বলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই প্রকাশ্যে বলাবলি করেন। কমিটি বাণিজ্য ছাড়াও ওবায়দুল কাদের সংগঠন বিক্রি করে আয় করেছেন অন্যভাবে। ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় জাতীয় নির্বাচন হয়েছে দুটি। স্থানীয় নির্বাচন হয়েছে দুটি। উপজেলা নির্বাচন হয়েছে দুটি। পৌর এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও হয়েছে। এসব নির্বাচনে প্রতীক দেওয়ার মাধ্যমে মনোনয়ন বাণিজ্যের পথ অবারিত করে দেওয়া হয়। বিরোধী দল যেহেতু এ ভোটারবিহীন একতরফা এবং প্রহসনের নির্বাচন বর্জন করে সেজন্য আওয়ামী লীগের লুটেরা দুর্বৃত্তরা মনোনয়ন পাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। এ সময় মনোনয়ন পেলেই এমপি হওয়া যাবে, পৌরসভার মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়া যাবে-এ রকম প্রত্যাশা থেকে সবাই টাকা ঢালতেন অকাতরে।

এসব পদে বসলেই অবাধে লুটপাটের পথ খুলে যেত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মনোনয়ন বাণিজ্যের টাকার প্রধান কালেক্টর ছিলেন আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। বিপ্লব বড়ুয়ার কাছে একটি তালিকা ছিল কোন মনোনয়নের জন্য কী ধরনের টাকা দিতে হবে। ধরা যাক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের জন্য ২০ লাখ থেকে শুরু করে ৫০ লাখ পর্যন্ত দেওয়ার ঘটনা রয়েছে। উপজেলার চেয়ারম্যানের জন্য ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত দেওয়ার নজির আছে। পৌরসভার মেয়র পদের জন্য ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি পর্যন্ত ঘুষ লেনদেনের ঘটনা ঘটেছে। আর সংসদ নির্বাচনের জন্য কোনো নির্ধারিত মূল্য ছিল না। রীতিমতো নিলামের মাধ্যমে টাকা তোলা হতো।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সর্বশেষ ডামি নির্বাচনের সময় ওবায়দুল কাদের শুধু ঢাকার একটি আসনে মনোনয়ন দিয়ে ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের এমপি সাবেক পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীকে মনোনয়ন দেবেন না বলে শেখ হাসিনা জানান দলের মনোনয়ন বোর্ডের সভায়। কিন্তু এরপর গোলাম দস্তগীর গাজী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করেন। ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে তাঁর শত কোটি টাকার লেনদেন পাকা হয়। এ টাকা সংগ্রহ করেন বিপ্লব বড়ুয়া সিঙ্গাপুরে গিয়ে। এ টাকার মাধ্যমে গোলাম দস্তগীর গাজী মনোনয়ন কিনে নেন। আওয়ামী লীগের এ রকম এমপির সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন, যারা টাকা ছাড়া এমপি হয়েছেন। সে সময় আওয়ামী লীগের নেতারা অভিযোগ করতেন, শুধু হাতেগোনা কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা টাকা ছাড়া এমপি হতে পারছেন।

কিন্তু বাকি সবাই এমপি হয়েছেন টাকার বিনিময়ে। ওবায়দুল কাদের এসব টাকা নিয়ে বলতেন, তিনি দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে ব্যয় করবেন। কিন্তু বাস্তবে সাংগঠনিক কার্যক্রম নয়, বরং তিনি তাঁর নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কমিটি বাণিজ্যের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা জেলার কমিটির ক্ষেত্রে। শেখ হাসিনার তৎকালীন বেসরকারি বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ঢাকা জেলা কমিটির জন্য ওবায়দুল কাদেরকে ২০০ কোটি টাকা দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ঢাকা জেলার কমিটি গঠন হওয়ার পর সালমান এফ রহমান কমিটির সদস্যদের নিয়ে যে বৈঠক করেন সে বৈঠকে তিনি বলেন যে ২০০ কোটি টাকা খরচ করে তোমাদের কমিটি করেছি। আমি যা বলব সেভাবে তোমাদের কাজ করতে হবে। না হলে আমি এ কমিটি বাতিল করে দেব। ওবায়দুল কাদের শুধু ছাত্রলীগ আর যুবলীগের কমিটি গঠন করতে পারেননি। গঠন করার ক্ষেত্রে তাঁর কোনো ভূমিকা ছিল না। কারণ যুবলীগের কমিটি বাণিজ্য করতেন শেখ ফজলে শামস পরশ এবং তাঁর স্ত্রী নাহিদ যূথী। অন্যদিকে ছাত্রলীগের কমিটি বাণিজ্য করতেন ছাত্রলীগের দুই নেতা। এসব কমিটি বাণিজ্যের ফলে ব্যবসায়ী, লুটেরা, চোরাকারবারি, মাদক কারবারি এমনকি খুনের মামলার আসামি পর্যন্ত বিভিন্ন কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন। যার ফলে আওয়ামী লীগের নেতারাই স্বীকার করেন যে কমিটি বাণিজ্য আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দিয়েছে। যে কমিটি বাণিজ্য থেকে হাজার কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ওবায়দুল কাদের নিজে।

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram