ঢাকা
২২শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
সন্ধ্যা ৬:০৯
logo
প্রকাশিত : জুন ২২, ২০২৫

করোনার চেয়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি, প্রতিরোধের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মোহনা (১০), থাকে রাজধানীর মহাখালীর ৭ তলা এলাকায়। তার জ্বর ও শরীর ব্যথা গেলো কয়েকদিন ধরেই। সন্দেহবশত তার মা নিয়ে এসেছেন রাজধানীর ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালে। ডাক্তার দেখানোর পর ডেঙ্গু টেস্ট দিয়েছেন। ডেঙ্গু নেগেটিভ এসেছে।

মোহনার মা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি বলেন, টেনশন ছিল, ডেঙ্গু হলো কি না। টেস্ট করে নিশ্চিত হলাম যে, হয়নি। আলহামদুলিল্লাহ।

একই হাসপাতালে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে নাখালপাড়ার মিজানুর রহমান। মা জাহানারা (৬০) ও মেয়ে মাইশাকে (৩) নিয়ে এসেছেন। তাদের জ্বর ও সর্দি-কাশি। সন্দেহবশত নিয়ে এসেছেন করোনা বা ডেঙ্গু হলো কি না, জানতে। টিকিট কেটে ডাক্তারের সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আছেন তারা।

চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ৭ হাজার ছাড়িয়েছে, একই সময়ে ৩৯৭ জনের করোনা শনাক্ত, মারা গেছে ১১ জন

মিজানুর রহমান বলেন, তুলনামূলক এখানে চাপ কম, সেবা ভালো। তাই এসেছি।

শুধু মিজানুর রহমান নয়, অন্তত ২০/২২জন রোগী ১০ টাকায় টিকিট কেটে ডাক্তারের লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের অধিকাংশই জ্বর, সর্দি বা শরীর ব্যথা নিয়ে এসেছেন। চিকিৎসকও দেখে টেস্ট করাতে দিচ্ছেন। এদের বেশিরভাগই ডেঙ্গু সাসপেক্টেড।

শনিবার সকাল ৯টার আগেই এমন চিত্র চোখে পড়ে রাজধানীর ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালে। রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু মহাখালী বা তার আশপাশ নয়, ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে এই হাসপাতালে সম্ভাব্য করোনা ও ডেঙ্গু আক্রান্তরা আসছেন। তাদের ধারণা, কোথাও না হলেও এখানে টেস্ট এবং চিকিৎসা পাওয়া যায়।

হাসপাতালটির নথি থেকে পাওয়া যায়, গেলো শুক্রবার ৪৫ জন কোভিড-১৯ টেস্ট করিয়েছেন। আর ডেঙ্গু টেস্ট করেছেন ১০০ জন। ছুটির এই দিনটিতেও প্রয়োজনের কারণে কোভিড-১৯ আক্রান্ত দুইজনকে ভর্তি দেওয়া হয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত ৬ জনকে ভর্তি দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে হাসপাতালটিতে ভর্তি আছে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ১৭ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত ২৮ জন। চিকনগুনিয়া আক্রান্ত একজন। এরমধ্যে অক্সিজেন সাপোর্ট লাগছে ৯ জনের।

এবছর এখন পর্যন্ত ৪৫ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত ভর্তি হন এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৯৬ জন ভর্তি হন। এরমধ্যে কোভিডে একজন এবং ডেঙ্গুতে দুইজন মারা গেছেন।

ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালের সামনের তথ্য বিবরণী বলছে, আইসিইউ বেড ২১২, এইচডিইউ বেড ২৮৮ এবং জেনারেল বেড ৫৫৪টি আছে।

বৃষ্টি হলেই ডেঙ্গু বাড়ে, এই সময়টাই ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। ডেঙ্গু থেকে বাঁচার প্রধানতম উপায় এডিস মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা-জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ

হাসপাতালটির পরিচালক কর্নেল তানভীর আহমেদ বলেন, হাসপাতালে রোগী ভর্তির উপযোগী ৩০০ বেড আছে। জনবল প্রাপ্তি সাপেক্ষে এক হাজার বেডে উন্নীত করার সুযোগ আছে। পাশাপাশি আইসিইউতে এখন ৪৫ বেড আছে, এটিও বাড়ানোর সুযোগ আছে জনবল প্রাপ্তি সাপেক্ষে।

ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালসহ ঢাকায় ১৮টি সরকারি হাসপাতাল এবং বেসরকারি ৫৯ হাসপাতাল/ক্লিনিকে করোনা ও ডেঙ্গু টেস্ট হচ্ছে। ঢাকার বাইরে প্রায় ৮০টি প্রতিষ্ঠানে করোনা ও ডেঙ্গু টেস্ট হচ্ছে। এসব রিপোর্টে উঠে আসছে করোনার চেয়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি।

সারাদেশে গত ২৪ (২১ জুনের রিপোর্ট) ঘণ্টায় ২১১টি নমুনা পরীক্ষায় চারজনের করোনা শনাক্ত এবং দুইজন মারা গেছেন। অপরদিকে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৩৫২ জন, মারা গেছেন একজন।

চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সাত হাজার ৪২৯ জন। তাদের মধ্যে ৫৯ দশমিক ২ শতাংশ পুরুষ এবং ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। এছাড়া এখন পর্যন্ত ছাড়পত্র পেয়েছেন ছয় হাজার ৫১৬ জন, মারা গেছেন ৩১ জন।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২১ জুন পর্যন্ত চার হাজার ৯৭৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৩৯৭ জনের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। এ সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১১ জন।

করোনা ও ডেঙ্গু নিয়ে কাজ করা হাসপাতালের এক হাসপাতালের পরিচালক বলেন, ‘সাধারণত জুলাই থেকে ডেঙ্গু শুরু হয়। এবার আগে থেকেই শুরু হলো। ধারণা করা হচ্ছে, জুলাই মাসে এটি ভয়াবহ রূপ নেবে। সে হিসেবে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

প্রতিরোধে করণীয়
এ বিষয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ভাইরাসজনিত এসব রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সবচেয়ে জরুরি। ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া হয় এডিস মশা থেকে। এটাকে গৃহপালিত মশা বলে। এটা থেকে বাঁচতে হবে। আপনার আমার ঘরেই এটার উৎপত্তি। ঘরেও হয়, ঘরের বাইরেও হয়। যেখানেই জমা পানি থাকে, মশা ডিম পাড়ে। কোথাও যেন জমা পানি না থাকে; ফ্রিজের নিচে, এসির নিচে, ফুলের টব, ছাদ বাগান, ঘরের চারপাশে, এমনকি বাথরুমের কমোডেও। পাশাপাশি ঘরবাড়ি পরিষ্কার করতে হবে। বাচ্চাদের ফুল প্যান্ট পরিয়ে রাখা, ঘুমাতে গেলে দিনে ও রাতে মশারি টানানো, এগুলো নাগরিকদের দায়িত্ব।

যে কারও জ্বর-সর্দি, গলা ব্যথা, মাথা ব্যথা হলেই ডেঙ্গু ও করোনা টেস্ট করে নেবে। দেরি করা যাবে না। লক্ষ্মণ দেখা গেলেই পরীক্ষা করতে হবে-ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

তিনি বলেন, ঘরের বাইরের দায়িত্ব প্রশাসনের। যেন কোথাও জমা পানি না থাকে। সড়কে বা খালি জায়গায় পরিত্যক্ত টায়ার, চিপসের প্যাকেট, পরিত্যক্ত হাড়ি, প্ল্যাস্টিকের চায়ের কাপ পড়ে থাকে। এগুলোতেও মশা ডিম পাড়ে। আগে বলা হতো পরিষ্কার পানি ডিম পাড়ে এডিস মশা, এখন নোংরা পানিতেও ডিম পাড়ে। প্রশাসন ও জনগণ মিলে সবার সমন্বিত পদক্ষেপে মশা নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। না হলে আমাদের রেহাই নেই। যে হারে বাড়ছে, আরও বাড়বে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, বৃষ্টি হলেই ডেঙ্গু বাড়ে। এখন বৃষ্টি হচ্ছে। এই সময়টাই ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। ডেঙ্গু থেকে বাঁচার প্রধানতম উপায় হলো এডিস মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা। এখন এডিস মশা থেকে বাঁচার কয়েকটা উপায় আছে, কেউ বহুতল ভবনে বসবাস করলে ভবনের ভেতরে বা আশপাশে যেন পানি না জমে সেটি খেয়াল রাখতে হবে। জমলে ফেলে দিতে হবে। ঘরের ভেতরেও যেন পানি না জমে। প্ল্যাস্টিকের ড্রাম বা মাটির মটকিতে অনেকে পানি সংরক্ষণ করেন। এসব পানি তিনদিনের বেশি রাখা যাবে না। তিনদিনেও ঢাকনা দিয়ে রাখতে হবে। না হয়, এডিস মশা এসে ডিম পাড়বে।

আক্রান্ত হলে করণীয়
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, যে কারও জ্বর সর্দি, গলা ব্যথা, মাথা ব্যথা হলেই ডেঙ্গু ও করোনা টেস্ট করে নেবে। দেরি করা যাবে না। লক্ষ্মণ দেখা গেলেই পরীক্ষা করতে হবে। অনেকে সময় ক্ষেপণ করে, দেখি, ভাইরাস জ্বর কি না, এই সেই বলে। সিরিয়াস হলে ডাক্তারের কাছে যায়, তখন কিন্তু সমস্যা হয়। আগেই পরীক্ষা করলে আগেই জানা যায়। জটিলতা এড়ানো সম্ভব। বেশিরভাগ রোগীর কিন্তু ঘরে বসেই চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব। প্যারাসিটামলের বাইরে কোনো ওষুধ খাবে না। প্রচুর পানি খাবে, ডাব, ওরস্যালাইন, গ্লুকোজ, ফলমূলের রস খাবে। আর যদি খেতে না পারে, বমি হয়, পাতলা পায়খানা হয়, অথবা যাদের অন্য রোগ আছে; ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার, কিডনি, লিভার ও ক্যানসারের রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নেওয়া সবচেয়ে ভালো। বয়স্ক, ছোট বাচ্চা ও নারীদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, জ্বর হলে এক দুইদিনের মধ্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে নেবেন। উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা হয়। অথবা কোনো হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও যাওয়া যাবে। জ্বর হলে প্রচুর পানি বা নানা ধরনের জুস পান করতে হবে। জ্বর হলে দুর্বলতা অনুভব করলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত ১৮টি হাসপাতাল-ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিজিবি হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, টিবি হাসপাতাল শ্যামলী, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল সাভার, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মহানগর শিশু হাসপাতাল, ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল। এর বাইরেও ৫৯টি হাসপাতালে এই সেবা দেওয়া হয়।

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram