আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের ব্যাংক খাত পুনর্গঠনকে অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে দেখছে অন্তর্বর্তী সরকার। টানা ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বে থাকা আতিউর রহমান, ফজলে কবির এবং আবদুর রউফ তালুকদারের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ব্যাংক খাত চরম দুর্দশায় পড়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ব্যাংক খাতকে “ব্ল্যাকহোল” আখ্যা দিয়ে জানিয়েছে, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণসহ মোট দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা।
২০০৯ সালে গভর্নরের দায়িত্বে আসা আতিউর রহমানের শুরুর দিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সীমিত থাকলেও পরে তা ভয়াবহভাবে বেড়ে যায়। তাঁর মেয়াদকালে হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতি এবং আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ নয়টি নতুন ব্যাংক অনুমোদন বিতর্ক জন্ম দেয়। ২০১৫ সালে রাজনৈতিক চাপের মুখে একাধিক ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা প্রদানে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেন তিনি এবং ২০১৬ সালে রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর পদত্যাগ করেন।
ফজলে কবির: দখলদারি ও লুটপাটের প্রসার রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর ২০১৬ সালে দায়িত্ব গ্রহণকারী ফজলে কবিরের আমলে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংক এস আলম গ্রুপের দখলে চলে যায়। গভীর রাতে বাসা থেকে এ দখল কার্যক্রম অনুমোদন দেওয়া, ঋণনীতিতে ছাড় এবং গ্রুপটির অনিয়ন্ত্রিত ঋণ সুবিধা প্রদানে ভূমিকা রাখেন তিনি। তাঁর মেয়াদে আইন পরিবর্তন করে গভর্নরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ বছরে উন্নীত করা হয়।
আবদুর রউফ তালুকদার: অর্থপাচারের ত্বরান্বিতকারী ২০২২ সালে গভর্নর হিসেবে দায়িত্বগ্রহণকারী আবদুর রউফ তালুকদারের সময়ে ব্যাংক খাতে অর্থপাচার আরও বেড়ে যায়। তাঁর আমলে ব্যাংকগুলোর ঘাটতি মেটাতে টাকা ছাপানোর মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, যা পরে ফের ঋণ হিসেবে বিতরণ করে এস আলম গ্রুপসহ প্রভাবশালী মহল বিদেশে পাচার করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে এবং আর্থিক তথ্য গোপন রাখা শুরু হয় তাঁর আমলেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, আগামী দিনে খেলাপি ঋণ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বিগত সরকারের সহযোগিতায় এস আলম গ্রুপ অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার (১ লাখ কোটি টাকা) বিদেশে পাচার করেছে।
তিন গভর্নরের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা থাকা সত্ত্বেও এখনও তাঁরা আইনের আওতায় আসেননি। নতুন সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলেও এ পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়নি। দেশের ব্যাংকব্যবস্থা আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, কিন্তু এর মূল হোতারা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে — যা আজকের বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক ট্র্যাজেডি।
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন