ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জেরে আবারও বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে হরমুজ প্রণালিকে ঘিরে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হলে ইরান বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সামুদ্রিক রুটটি বন্ধ করে দিতে পারে – যার প্রভাব পড়বে পুরো বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর। বিশ্লেষকরা বলছেন, হরমুজ প্রণালি সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও এর প্রভাব হবে বৈশ্বিক। বিশেষত ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো দেশগুলো, যারা তেলের জন্য উপসাগরীয় দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল, তারা পড়বে সরাসরি ঝুঁকিতে।
হরমুজ প্রণালির কৌশলগত গুরুত্ব
এই প্রণালি ইরান ও ওমানের মধ্যে অবস্থিত এবং বিশ্বের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অপরিশোধিত তেল এখান দিয়েই পরিবাহিত হয়। সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ মাত্র ৪০ কিলোমিটার প্রশস্ত হলেও, এখান দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয় (২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী)। এটি বছরে প্রায় ৬০ হাজার কোটি ডলারের জ্বালানি বাণিজ্যের সমতুল্য। তাই এর যেকোনো রকম বিঘ্নতা তেলের দাম দ্রুত বাড়িয়ে দিতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।
ইরান কিভাবে প্রণালি বন্ধ করতে পারে?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা ইরানের জন্য অনেকটা পরমাণু অস্ত্রের মতো কৌশলগত প্রতিরোধ ক্ষমতা। ইরান চাইলে ধাপে ধাপে এই প্রণালি বন্ধ করতে পারে, যেমন—
১। চলাচল সীমিত করা বা নিষিদ্ধ ঘোষণা।
২। সামরিক নৌযানের উপস্থিতি বাড়ানো।
৩। ন্যাভাল মাইন স্থাপন।
৪। সাবমেরিন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলার হুমকি।
৫। বাণিজ্যিক জাহাজ জব্দ করা।
১৯৮০–৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধেও ইরান এই প্রণালি ব্যবহার করে একাধিক সামরিক কৌশল গ্রহণ করেছিল।
ইরানের সামরিক প্রস্তুতি
ইরানের ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কোর সম্প্রতি হরমুজ প্রণালির কাছে তাদের নৌবাহিনীর ইউনিট পরিদর্শন করেছে। হাই-স্পিড ক্ষেপণাস্ত্রবাহী নৌযান, সাবমেরিন, অ্যান্টি-শিপ মাইন এবং ড্রোন দিয়ে তারা যে কোনো মুহূর্তে বড় আকারের সামরিক কৌশল গ্রহণ করতে সক্ষম—এমন বার্তাই দিচ্ছে তেহরান।
কোন দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
ভোরটেক্সা এবং ইআইএ-এর তথ্য অনুযায়ী, হরমুজ প্রণালি দিয়ে সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানি করে সৌদি আরব।
আর আমদানির দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল চীন, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া।
চীন: তেলের অন্যতম বৃহৎ গ্রাহক, ইরান থেকে তুলনামূলক কম দামে তেল আমদানি করে।
দক্ষিণ কোরিয়া: তাদের তেলের ৬০% আসে হরমুজ প্রণালি দিয়ে।
ভারত: বৃহৎ পরিসরে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে আমদানি করে।
যুক্তরাষ্ট্র: এই প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৭ লাখ ব্যারেল তেল নেয়, যা মোট আমদানির ১১%।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে ইরানের মিত্র চীন ও ভারতের ওপরও অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হতে পারে।
বিকল্প রুট কতটা কার্যকর?
হরমুজ প্রণালি বন্ধের আশঙ্কা বহুদিন ধরেই থাকায় কয়েকটি উপসাগরীয় দেশ বিকল্প পাইপলাইন তৈরি করেছে।
সৌদি আরব: ১,২০০ কিমি দীর্ঘ পূর্ব-পশ্চিম পাইপলাইন দিয়ে প্রতিদিন ৫০ লাখ ব্যারেল তেল পরিবহন সম্ভব।
সংযুক্ত আরব আমিরাত: ওমান উপসাগরের ফুজাইরাহ বন্দর পর্যন্ত পাইপলাইন (১৫ লাখ ব্যারেল/দিন)।
ইরান: গোরেহ-জাস্ক পাইপলাইন (৩.৫ লাখ ব্যারেল/দিন ক্ষমতা) নির্মিত, তবে সম্পূর্ণরূপে চালু নয়।
এই বিকল্প রুটগুলো সম্মিলিতভাবে বর্তমানে হরমুজ প্রণালি নির্ভরতা কমাতে পারলেও তা প্রণালির বিকল্প হতে পারবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
চূড়ান্ত বিশ্লেষণ
বিশেষজ্ঞদের মতে, হরমুজ প্রণালি সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও, যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো সামরিক উপায়ে তা দ্রুত খুলে দিতে পারে। তবুও এমন ঘটনা হলে তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে উঠতে পারে। ইরান এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে কিনা তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও সামরিক উত্তেজনার গতিপথের ওপর। তবে এটি স্পষ্ট—হরমুজ প্রণালির নিরাপত্তা রক্ষা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নয়, গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র : বিবিসি