গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে তাদের মেয়াদ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা চলছিল। এমন এক প্রেক্ষাপটে গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না পেয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সম্প্রতি দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নির্বাচন প্রলম্বিত করার চেষ্টার অভিযোগ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে চাইলে নির্বাচিত হয়ে আসেন।
অনির্বাচিত কাউকে দেশের মানুষ দীর্ঘ সময় মেনে নেবে না।
নির্বাচিত-অনির্বাচিত নিয়ে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যেরও জবাব আসে সরকারের একজন উপদেষ্টার কাছ থেকে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার গত ১২ এপ্রিল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা অনির্বাচিত- এই কথা কে বলল? আমাদের তো ছাত্ররা, জনতা- যারা নাকি এই পরিবর্তনটা এনে দিয়েছে, তারাই সরকার গঠন করেছে, তাদের দ্বারা নির্বাচিত আমরা।’
দেশের রাজনীতিতে নির্বাচন নিয়ে সরকারের প্রতি সন্দেহ যেমন বাড়ছে, একইসঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের লম্বা সময় এমনকি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার প্রসঙ্গ উঠছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা কি সম্ভব? এ বিষয়ে বিশ্লেষক ও রাজনীতিকদের অনেকে মনে করেন, সরকারের দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার প্রসঙ্গ আলোচনায় আসার পেছনে নির্বাচনের রোডম্যাপ না দেওয়ায় বিষয়টি অন্যতম একটি কারণ। এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার প্রসঙ্গ আলোচনায় আসা বা পরিস্থিতির জন্য বিএনপির দায় রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
লেখক, বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ভোট হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে, এই ধারণা থেকে দলটির নেতাকর্মীরা সারা দেশে একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত চাঁদাবাজি, দখলসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। নেতাকর্মীদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিএনপির ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
মানুষ পতিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের পার্থক্য দেখতে পাচ্ছে না। যদিও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে। সারা দেশে দলটির এবং এর অঙ্গ, সহযোগী সংগঠনগুলোর বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বহিষ্কার করাসহ সাংগঠনিক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু চাঁদাবাজি, দখলের মতো অপরাধ থামানো যায়নি।
এখানেই বিএনপির দায় দেখছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, এমন একটা ধারণা সাধারণ মানুষের অনেকের মধ্যে তৈরি হয়েছে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকলে প্রথমত আইনগত প্রশ্ন উঠতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে সরকারের প্রতি তখন কতটা সমর্থন থাকবে, সেটিও একটি বিষয় বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
যেহেতু বর্তমান সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কোনো ব্যবস্থা নেই, সে কারণে গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে আন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সমর্থনে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত নেওয়া হয়েছিল।
তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বিষয়টাকে ব্যখ্যা করেন ভিন্নভাবে। তিনি বলেন, আদালতের মতামত এবং রায়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। মতামত মানার বাধ্যবাধকতা থাকে না, যেটা রায়ে থাকে।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ক্ষমতার আসা ও সামরিক শাসন রেখে রাষ্ট্র পরিচালনার সময়টাকে বৈধ্যতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে। আর সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনকে।
এই দুটি সংশোধনীই আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। দুটি সংশোধনীই বাতিল করেছিল আদালত। রায়ে বলা হয়েছিল, জাতীয় নিরাপত্তা বা জাতীয় কোনো প্রয়োজনেই অসাংবিধানিক কোনো বিষয়কে বৈধতা দেওয়া যাবে না।
আইনজীবী শাহদীন মালিকের বক্তব্য হচ্ছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারকেই নির্বাচিত সংসদে বৈধতা দিতে হবে। সেখানে অনির্বাচিত সরকার পাঁচ বছর বা দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকলে আইনগত প্রশ্ন উঠতে পারে।
বৈধতার প্রশ্নের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকেও সমস্যা তৈরি হতে পারে। একটি অনির্বাচিত সরকার নির্বাচন না দিয়ে দীর্ঘ সময় থাকলে, এই সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
দেশের ভেতরেও এই সরকারের অংশীজন হিসেবে রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন পক্ষ রয়েছে। সেখানে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল দ্রুত নির্বাচন চাইছে। ফলে অংশীজনদের সঙ্গেও সরকারের দূরত্ব বাড়তে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, সরকারের সময় দীর্ঘ হলে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেটা আমাদের চিন্তার ও ধারণার আড়ালে থাকতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে এ সরকারের লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকা কঠিন।
সূত্র : বিবিসি বাংলা।