চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি: এ যেন সিনেমার আয়নাবাজির গল্প। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা ঘটেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। একটি রিকশা আর কিছু টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মাদকসেবী মিঠুনকে কারাগারে পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে, চেক ডিজঅনারের মামলায় এক বছরের সাজাপ্রাপ্ত কানসাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য সেতাউরের বিরুদ্ধে।
জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বিশ্বনাথপুর পশ্চিম মোমিনপাড়া গ্রামের মোঃ সেরাজুল ইসলামের ছেলে ও মেসার্স চাঁদ ব্রেড এন্ড বেকারীর স¦ত্বাধিকারী মোঃ সেতাউর রহমান। রাজশাহী যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ ১ম আদালতে, রাজশাহী’র বায়া এলাকার এফএম অটোরাইস অ্যান্ড ফ্লাওয়ার মিলের দায়েরকৃত ৭০ লাখ টাকার চেক ডিজঅনারের মামলায় গত ১৮ এপ্রিল এক বছরের সাজাপ্রাপ্ত হন। কিন্তু মামলার রায় ঘোষনার সময় আসামী সেতাউর পলাতক ছিলেন। এরপর গত ২৭ অক্টোবর ওই মামলায় আদালতে আত্মসমর্পন করলে আদালত জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। কিন্তু অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, আসামী সেতাউর রহমান আদৌতে জেলে প্রবেশই
করেননি। তাঁর নাম-ঠিকানা নিয়ে গত অক্টোবর মাস থেকে আত্মসমর্পনের পর মৌখিক চুক্তিতে ভাড়ায় জেল খাটছেন জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বিশ্বনাথপুর গ্রামের মো. রেজাউল করিমের ছেলে মো. মিঠন (৩২)।
গত ১৬ জানুয়ারী চাঁপাইনবাবগঞ্জ আদালতে সেতাউরের চেক ডিজঅনারের অপর আরেকটি মামলার শুনানিতে সেতাউরকে হাজির করলে কাঠগড়ায় দেখা যায় মিঠুনকে। এ নিয়ে মামলার বাদী আদালতের বিচারককে আপত্তি (এই আসামী সেতাউর নয়) জানালে বেরিয়ে আসে সেতাউরের প্রতারনার কাহিনী।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ভাড়ায় জেল খাটা মিঠুনের সহজ স্বীকারোক্তি মাদকাসক্ত থেকে মুক্তি পেতে একটি রিকসা আর কিছু টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সেতাউরের পরিবর্তে জেল খাটছে মিঠুন।
মোঃ মিঠন বলেন, আমি মাদকাসক্ত ছিলাম এবং আমি প্রতিবেশী সাবেক ইউপি মেম্বার সেতাউরের কাছে গেলে সে নেশা ছাড়ার ব্যাপারে আমাকে বলে, তুই কিছুদিন জেলে থাকলে তোর নেশা ছুটে যাবে। এই কথা বলে সে আমাকে রাজশাহীতে নিয়ে গিয়ে শেষবারের মতো নেশা করিয়ে বলে, তুই শুধু আমার নাম ও আমার বাবার নাম এবং গ্রামের নাম বলবি। তুই জেলে কিছুদিন থাকলে, তাতে ভালো হয়ে গেলে, আমি খুব তাড়াতাড়ি তোকে জেল থেকে ছাড়িয়ে
এনে, একটি রিক্সা কিনে দিবো। আর তোর ও তোর পরিবারের খরচ আমি চালাবো। একথা বলে আমাকে আদালতে হাজির করে রাজশাহীর জেলে ঢুকিয়ে দেয়।
ভাড়ায় জেল খাটা মোঃ মিঠুন আরও বলেন, আমার ৩ মাস দিন থাকা হচ্ছে। তাতে সে পিসিতে ৬ হাজার টাকা দিয়েছে। আর সেতাউর কিছুদিন আগে যখন রাজশাহীতে যায়। তখন আমি তাকে বলি, আমাকে এতোদিন হয়ে যাচ্ছে জেল থেকে ছাড়াচ্ছেনা কেন। সে তখন বলে তুই এবিষয় কাউকে বললে সারাজীবন জেলে থাকবি। আর আমার কিছুই হবে না। এখন সব জানাজানি হয়ে গেছে। আমি ভুল করেছি। নেশার ভারে কি বলেছি; আমি নিজেই জানি না। এখন আমি মুক্তি চাচ্ছি। সরকারের কাছে এটাই আমার চাওয়া।
মোঃ মিঠনের স্ত্রী মোসা. আশা খাতুন বলেন,আমার স্বামী একজন মাদকাসক্ত। তাকে প্রলোভন এবং টাকার লোভ দেখিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে জেল থেকে বের করে নেয়ার কথা বলে জেলে পাঠিয়েছে। এখানে আমার স্বামী ভালো হওয়ার জন্য জেলে গেছিলো। দীর্ঘ সংসার-জীবনে আমাকে অত্যাচার করেছে এবং আমি সহ্য করতে না পেরে বাপের বাড়িতে চলে আসি। পরে শুনি সে জেলে গেছে।
তিনি আরও বলেন, তিন সন্তান নিয়ে আমি খুব কষ্টে আছি। আমাকে সেতাউর এ কয়েকমাসে ৩-৪ হাজার টাকা দিয়েছে। অথচ আমার স্বামী বলেছিল মাসে মাসে ৪ হাজার হাজার টাকা দিবে।
মিঠুনের মা মোাসঃ আখতারা বেগম জানান, তারা এসবের কিছুই জানেন না, তিনি অভিযোগ করেন প্রলোভন দেখিয়ে মিঠুনকে ফাঁসিয়েছে সেতাউর। এ ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুতই মুক্তি চান মিঠুনের পরিবার।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে যুগ্ম দায়রা জজ ২য় আদালতে দায়েরকৃত মামলার বাদী এ্যাডভোকেট আব্দুল মালেক জানান, আমি সেতাউর রহমানের বিরুদ্ধে ৭৫ হাজার টাকার একটি চেকের মামলা করি। দীর্ঘ বিচার শেষে আদালত সেতাউর রহমানকে এক বছরের সাজা ও চেকে বর্ণিত টাকা অর্থদন্ড প্রদানের রায় দেন। কিন্তু সে অর্ধেক টাকা জমা দিয়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আপলি করে। তাতে হাইকোর্ট তার সাজা কমিয়ে ১৫ দিন করে এবং তিন মাসের মধ্যে টাকা পরিশোধের সময় দেয়। বাকী টাকা সে আমাকে গত ১৪ জানুয়ারী পরিশোধ করেছে। তাই আমি আদালতে মামলা নিস্পত্তির জন্য পিটিশন দাখিল করি। শুনানীর জন্য ১৬ জানুয়ারি আদালতে আসামীকে
হাজির করলে সেতাউর রহমানের স্থলে মোঃ মিঠুন নামের আরেকজনকে হাজির করানো হয়। এবং মোঃ মিঠুন আদালতের কাছে পুরো ঘটনা স্বীকার করে জবানবন্দী দেন। আর সেতাউর প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
সেতাউর রহমানের রাজশাহীর আরেকটি চেকের মামলার বাদী (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) মোঃ সাজেদুর রহমান বলেন, ৭০ লাখ টাকার চেকের মামলায় সেতাউর রহমানকে এক বছরের সাজা প্রদান করেন আদালত। কিন্তু আদালতের কাছে গত বছরের ২৭ অক্টোবর সে আত্নসমর্পন না করে মোঃ মিঠুন নামের একজনকে হাজির করে। এতে আমাদের সন্দেহ হলে গত ১৬ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ আদালতে এসে দেখি সেতাউরের বদলে মিঠুন নামের একজন সাজা খাটছেন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন মেহেদী বলেন, একজন আসামীর সাজা আরেকজন অর্থের বিনিময়ে ভোগ করছে। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এখানে সবাইকে সতর্ক হওয়া উচিত। আর যেহেতু মোঃ মিঠন সেতাউরের সাজা ভোগ করছেন। সেহেতেু তিনি যেমন অপরাধী তেমনী উভয়ে সমান অপরাধী।’
এদিকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী আদালতের দুই মামলাতেই তথ্য গোপন ও প্রতারণার অভিযোগে সেতাউরের বিচার চেয়েছেন মামলার বাদীরাও।
রাজশাহী যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ ১ম আদালতে দায়েরকৃত মামলার আসামী সেতাউরের আইনজীবী এ্যাডভোকেট সফিউল আজম বলেন, কিভাবে আসামী পরিবর্তন হয়েছে এটি জানা নেই তার। তবে আসামী অপরাধ করেছে; এতে তার কোন দায় নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে একাধিক মামলার আসামিও এই সেতাউর রহমান। আর এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য সাজাপ্রাপ্ত মূলআসামি সেতাউরের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গেলেও; তাকে পাওয়া যায়নি। উল্টো বাসায় তালা লাগিয়ে লাপাত্তা সেতাউর। এমনকি মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও; কোন সাড়া পাওয়া যায়নি তার।