শামীম আখতার, মিঠাপুকুর (রংপুর): কৃষক পরিবারের একমাত্র ছেলে সোহানুর জামান নয়ন একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হতে চেয়েছিলেন। ছেলেকে নিয়ে বাবা-মা ও একমাত্র বোনেরও স্বপ্ন ছিল নয়ন বড় অফিসার হবে। বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। সচিবালয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে ট্রাক চাপায় মৃত্যু হয় ফায়ার ফাইটার নয়নের।
নিহত সোয়ানুর জামান নয়ন (২৪) মিঠাপুকুর উপজেলার বড়বালা ইউনিয়নের ছড়ান আটপুনিয়া গ্রামের কৃষক আখতারুজ্জামানের একমাত্র ছেলে।
বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ঢাকা থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে মিঠাপুকুরে গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছায় নয়নের কফিনবন্দি মরদেহ। তাকে একনজর দেখতে অ্যাম্বুলেন্সের পিছু ছুটে আসেন হাজারো মানুষ। বাড়ি জুড়ে তৈরী হয় আহাজারি, কান্নার রোল। একমাত্র ছেলে সন্তান বিয়োগের ব্যথা সইতে না পেরে নিজের বুক চাপড়ে কাঁদতে থাকেন মা নার্গিস বেগম ও বাবা আক্তারুজ্জামান। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা মরদেহ নামানোর পর তাঁকে একনজর
দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকেই। পরে তাঁর কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় গার্ড অব অনার।
রাত পৌনে এগারোটার দিকে বাড়ির পাশের একটি মাঠে অনুষ্ঠিত হয় জানাজা। এরপর বাড়ি থেকে একটু দূরে পারিবারিক কবরস্থানে জেঠাইমার (বড় আম্মা) কবরের পাশে দাফন করা হয় ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়নকে। উপজেলা জামায়াত ও বিএনপির নেতাকর্মীরা সহ বিভিন্ন শেনীপেশার মানুষ এসয় উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, নয়ন ২০১৬ সালে ছড়ান দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১৮ সালে ছড়ান ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ওই কলেজেই ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হন। এরপর ফায়ার সার্ভিসে যোগ দেন।
নয়নের মূল কর্মস্থল ছিল সিলেটের বিশ্বনাথ ফায়ার স্টেশনে। সেখান থেকে তিনি ঢাকার তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনে যোগ দেন। ২১ দিন ট্রেনিং করে বিশেষ টিমে কাজ করেছিলেন নয়ন।
এদিকে নিথর দেহে গ্রামে ফিরে আসা নয়নের মরদেহ উঠানে নিতেই তাকে শেষবারের মতো এক পলক দেখতে দূরদূরান্ত থেকে আসা আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ তার বন্ধুবান্ধবরা ভেঙে পড়েন কান্নায়। হৃদয়বিদারক এক দৃশ্যে
পরিণত হয় পুরো বাড়িজুড়ে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বিলাপ করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন মা নার্গিস বেগম। বাকরুদ্ধ হয়ে ছেলের কফিনের দিকে তাকিয়ে থাকা বাবা আখতারুজ্জামান ফেলছিলেন দীর্ঘশ্বাস।
নিহত নয়নের বাবা আখতারুজ্জামান জানান, নয়নের অনেক স্বপ্ন ছিল এই চাকরিকে ঘিরে। চাকরির পাশাপাশি প্রোমোশনের জন্য পড়াশোনাও চালিয়ে গিয়েছিল। ছড়ান ডিগ্রি কলেজ থেকে এই বছর বিএ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। এখন ছেলে আমার ফল প্রত্যাশী ছিল। প্রোমোশন পেলে বিয়ে ও বাড়ি গোছানোর কাজসহ কত স্বপ্ন ছিল ওর। কিন্তু আজ সবকিছু শেষ, আমার আর কিছুই থাকল না।
নয়নের সহকর্মীরা জানান, বৃহস্পতিবার সকালেই ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল তার। সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করে রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু মধ্যরাতে ডাক পড়ায় ঘুম থেকে উঠেই যোগ দিয়েছিলেন পেশাগত দায়িত্ব পালনে। সেখানে সচিবালয়ের আগুন নেভানোর আগেই নিভে যায় নয়নের জীবন প্রদীপ।
মিঠাপুকুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ইনচার্জ ও ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর মশিউর রহমান বলেন, সহকর্মী নয়নের এমন মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। লাশ নিয়ে আসা পর্যন্ত আমরা নয়নের বাড়িতেই অবস্থান করেছি। গার্ড অব অনার প্রদান শেষে নয়নের দাফনকার্য সম্পন্ন করা হয়।