

মিরসরাই (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি: চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ছুরিকাঘাতে তাহমিদ উল্যাহ (১৮) নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতা নিহত হয়েছেন। বুধবার (১০ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ১ টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় বারইয়ারহাট পৌরবাজারে একটি দোকানে পায়ের উপর পা তুলে বসাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে রায়হান, আবির, মোজাম্মেলসহ ৭-৮ জন আহত হয়। তাহমিদ বারইয়ারহাট পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব হিঙ্গুলী এলাকার আলমগীর কোম্পানি বাড়ির বাস চালক আলমগীর হোসেন ও বিবি জোহরার একমাত্র ছেলে। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সদস্য ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন মিরসরাই উপজেলা শাখার যুগ্ম সদস্য সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া দি রেড জুলাই মঞ্চের আহবায়ক, আপ বাংলাদেশ চট্টগ্রাম উত্তর জেলার সদস্য ও ধর্ষণ প্রতিরোধ মঞ্চের উদ্যোক্তা ছিলেন।
পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বুধবার সন্ধ্যায় হিঙ্গুলী ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব জুবায়ের বারইয়ারহাট পৌরসভার একটি দোকানে পায়ের উপর পা তুলে বসেছিলেন। এসময় দোকানে আসেন বারইয়ারহাট পৌর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহবায়ক নজরুল ইসলাম লিটন। তাকে দেখে জুবায়ের পা নামিয়ে না বসায় লিটন জুবায়েরকে লাথি মারে। এরপর উভয় পক্ষ বাকবিতন্ডায় জড়ায়। পরবর্তীতে লিটন ও জুবায়ের নিজ নিজ এলাকা জামালপুর ও হিঙ্গুলীর লোকজন নিয়ে আসলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে নিহত জুলাই যোদ্ধা তাহমিদসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। গুরুতর আহত তাহমিদকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে প্রথমে বারইয়ারহাট জেনারেল হাসপাতালে এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১ টার সময় তার মৃত্যু হয়।
এদিকে তাহমিদ খুনের ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। অপরদিকে শোক জানিয়ে দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দিয়েছে আপ বাংলাদেশ (ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ)। সংগঠনের মুখপাত্র শাহরিন সুলতানা ইরা স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে খুনীদের সনাক্ত করে অবিলম্বে গ্রেফতারের জোর দাবী জানান।
সংঘর্ষে জড়িতরা চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে বিএনপি মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী নুরুল আমিন চেয়ারম্যানের অনুসারী।
এ বিষয়ে নুরুল আমিন চেয়ারম্যান বলেন, ‘তাহমিদ নিহত হওয়ার খবর শুনে আমরা সবাই শোকাহত। এই ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই। হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের কঠিন বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। আমি নিশ্চিত করে বলতেছি এটা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষের জেরে হত্যাকাণ্ড হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই হত্যাকান্ড বিএনপির দলীয় কোন বিষয় নয়। আমাদের এক কর্মীর পা তুলে বসা নিয়ে বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম লিটনের সাথে বাগবিতণ্ডা থেকেই দুই গ্রামের লোকজন সংঘর্ষে জড়ায়। সংঘর্ষে তাহমিদ নিহত হয়। পরশুদিন ছেলেটি আমার সাথে দেখা করে এবং ছাত্রদলের রাজনীতি করতে চায় বলে জানান। আমি তাকে বারইয়ারহাট পৌরসভা বিএনপির সাবেক আহবায়ক দিদারুল আলম মিয়াজীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছিলাম।’
এ বিষয়ে বারইয়ারহাট পৌরসভা বিএনপির সাবেক আহবায়ক দিদারুল আলম মিয়াজী বলেন, ‘আমাদেও মিটিং মিছিলে থাকতো তাহমিদ। তার খুনের বিষয়টি দলীয় কোন বিষয় নয়, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরে তুচ্ছ ঘটনায় সে খুন হয়েছে।’
এ বিষয়ে বারইয়ারহাট পৌরসভা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম লিটন বলেন, ‘ঘটনার আগে এলাকায় ছেলেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এসময় জুবায়েরের সাথে আমার হাতাহাতি হয়। এরপর তারা বারইয়ারহাট চলে যায়। সেখানে আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই। এরপর কি হয়েছে আমার জানা নেই। অভ্যন্তরীণ পূর্বশত্রুতার জেরে এমনটা ঘটতে পারে।’
বারইয়ারহাট পৌরসভা ছাত্রদলের সদস্য সচিব মোহন দে বলেন, ‘তাহমিদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন সংগঠনে সে কাজ করেছে। কিছুদিন আগে থেকে সে আমার সাথে চলাফেরা করতো। ছাত্রদলের রাজনীতি করার মনস্থিরও করেছে। যারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যুক্ত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
নিহত তাহমিদের মা বিবি জোহরা বিলাপ করে বলেন, ‘আমার পুতের খুনি আনি দে আমি তারে দেখতে চাই, জিজ্ঞাস করতে চাই। বিকালে পরীক্ষা দিয়ে এসে ভাত খেয়ে ঘরে বসে মোবাইল টিপতেছে। বিকেল ৪ টার দিকে একটা ছেলে তাকে ফোন দিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য ডাক দিলে সে বেরিয়ে যায়। আল্লাহ আজরাইল পাঠাইছে আমার ঘরে, আমার পুতেরে আমার থেকে লই যাইবেরগইরল্লাই।’
তিনি আরো বলেন, ‘আহত হওয়ার পর এ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেওয়ার সময় পুতেরে অনেকবার জিজ্ঞাস করছি কে মারছে হুতে কইতে হারে ন, মোবাইল খুঁজছে। তারে ত মোবাইল দিই ন, মোবাইল দিলে হয়তো পুতে খুনীর নাম লিখে দিতো।’
নিহত তাহমিদের বড় বোন ফারিহা আক্তার বলেন, ‘আমার ভাই ছিল জুলাই যোদ্ধা। সে ২৪ সালের ৪ আগস্ট আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিল। সমাজের অনেক মানুষের উপকার করতো। ২০২৪ সালে ফেনীতে ভয়াবহ বন্যার সময়ও সে কাজ করেছে মানুষের জন্য। আমার ভাইটাকে নোংরা রাজনীতির লোকজন মেরে ফেলেছে। আমার ভাই একজন কোরআনের হাফেজ ছিল। আমাদের একমাত্র ভাইকে আমরা হারিয়ে ফেললাম। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’
নিহত তাহমিদের বাবা আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলেকে এভাবে মেরে ফেললো? ও তো কোন দোষ করেনি। যদি দোষ করে থাকে, তাহলে আমি বিচার করতাম। তাই বলে তাকে শেষ করে দিতে হবে? আমি এখন কী নিয়ে বাঁচবো? আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম উত্তর জেলার সংগঠক সাইফুল হাওলাদার বলেন, ‘তাহমিদ জুলাই যোদ্ধা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারির সদস্য ছিল। ফেনী জেলা শহরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তার পেটে পুলিশের গুলি লেগেছিল। তিনি দি রেড জুলাই মিরসরাই উপজেলার আহবায়ক ছিলেন এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম উত্তর জেলার সদস্য ছিলেন। তাকে এভাবে কুপিয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছি আমরা।’
মিরসরাই সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার নাদিম হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘তাহমিদ হত্যার পেছনে কারা জড়িত, কারা তাকে গুরুতর আঘাত করেছে, যার ফলে তার মৃত্যু হয় এ ব্যাপারে বিস্তারিত তদন্ত ও ফুটেজ বিশ্লেষণ করছি। পরবর্তীতে আমরা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেব। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত, যা থেকে বড় সংঘর্ষে রুপ নেয়। সে কোন দলের রাজনীতির সাথে জড়িত কিনা ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাচ্ছি আমরা তা তদন্ত করে দেখছি।’

