ঢাকা
১৩ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
রাত ৮:৫২
logo
প্রকাশিত : জুন ১২, ২০২৫

ভুল অ্যাকাউন্টে ফান্ড ট্রান্সফার রোধে গ্রাহকের যা জানা জরুরি

অংকের সবকিছু ঠিক থাকলেও একটি সংখ্যার ভুলে যেমন পুরো হিসাবটাই ভেস্তে যায় তেমনি একটি ছোট ভুল—তার ফলাফল হতে পারে অপূরণীয় ক্ষতি। ডিজিটাল লেনদেনের এ যুগে মাত্র একটি সংখ্যার গণ্ডগোল কিংবা সামান্য অসতর্কতা একটি বড় অঙ্কের টাকা ভুল অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিতে পারে। আর একবার টাকা অন্যের অ্যাকাউন্টে গেলে তা ফেরত পাওয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। এতে যেমন গ্রাহক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর আস্থার সংকটও দেখা দিতে পারে।

এমনকি সেন্ডার ও রিসিভার এর মধ্যে তাৎক্ষণিক নেতিবাচক সম্পর্ক তৈরি করে। আর ডিজিটাল ব্যাংকিং সুবিধার মাধ্যমে গ্রাহকরা মুহূর্তেই টাকা পাঠাতে পারেন ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল অ্যাপ, ইউপিআই বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (বিকাশ, নগদ, রকেট) প্লাটফর্মে । এই গতি ও সহজতার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে একটি বড় ঝুঁকি—ভুল অ্যাকাউন্টে ফান্ড ট্রান্সফার। যার জন্য গ্রাহক নিজেই দায়ী।

ভুল ফান্ড ট্রান্সফারের সাধারণ কারণসমূহ—

১. ভুল অ্যাকাউন্ট নম্বর টাইপ করা
টাকা পাঠাতে গিয়ে যদি একটি মাত্র সংখ্যাও ভুল টাইপ হয়, তাহলে পুরো টাকা চলে যেতে পারে ভিন্ন ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে। অনেকেই বারবার একই ভুল করেন কারণ তারা কপি-পেস্ট না করে নাম্বার টাইপ করেন।

২. প্রাপক নাম যাচাই না করা
অনেক লেনদেন প্ল্যাটফর্মে প্রাপক নাম আংশিক দেখায় বা একেবারেই দেখায় না। ফলে নামের সঙ্গে অ্যাকাউন্ট মিল না হওয়ার কারণে ভুল ফান্ড ট্রান্সফার হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাপক নাম না দেখলে লেনদেন এড়ানোই ভালো।

৩. স্ক্যাম বা প্রতারণার ফাঁদে পড়া
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, মেসেজ বা কলের মাধ্যমে প্রতারকেরা প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকেন। তারা ভুয়া অ্যাকাউন্ট নম্বর দেয় যা যাচাই না করেই অনেক গ্রাহক টাকা পাঠিয়ে দেন।

৪. ভুল কন্টাক্ট বা QR কোড স্ক্যান
QR কোড খুব সহজ এবং দ্রুত লেনদেনের উপায় হলেও, প্রতারকেরা একই স্থান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভুয়া QR কোড বসিয়ে দিতে পারে। একবার স্ক্যান করলেই টাকা চলে যায় ভিন্ন অ্যাকাউন্টে।

৫. কনট্যাক্ট লিস্টের পুরাতন তথ্য ব্যবহার
মোবাইলে সংরক্ষিত পুরাতন অ্যাকাউন্ট নম্বর বা মোবাইল নাম্বার ভুল হয়ে যেতে পারে। ফলে, পূর্বে ব্যবহৃত তথ্য যাচাই না করেই পাঠানো হলে টাকা চলে যেতে পারে ভিন্ন প্রাপকের কাছে।

গ্রাহকের সচেতনতায় কী কী জানা ও মানা জরুরি?

১. তথ্য যাচাই করা
প্রাপকের অ্যাকাউন্ট নম্বর, ব্যাংকের নাম, শাখা, রাউটিং নম্বর ও অ্যাকাউন্ট টাইটেল বা নামের বানান যাচাই না করে কখনোই টাকা পাঠাবেন না। যতবার সম্ভব তা রিভিউ করুন।

২. প্রাপকের নাম মিলিয়ে দেখা
অ্যাকাউন্ট টাইটেল বা প্রাপক নাম যদি আংশিক দেখা যায়, তবুও বানান এবং পরিচয় অনুযায়ী মিলিয়ে নিশ্চিত হোন। যেকোন সন্দেহ থাকলে লেনদেন স্থগিত করুন।

৩. সেভড কন্টাক্ট ব্যবহারে সচেতনতা
আপনার মোবাইলে সেভ করা কন্টাক্টের তথ্য সময়ে সময়ে আপডেট করুন। পুরাতন নাম্বার বা নামের ভিন্নতা থাকলে যাচাই না করে ব্যবহার করবেন না।

৪. QR কোড স্ক্যানের সময় সতর্কতা
QR কোড স্ক্যান করার আগে খেয়াল করুন সেটি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর কী না। দোকানের নাম বা লোগোর সঙ্গে QR কোডের মিল আছে কিনা যাচাই করুন।

৫. মেসেজ বা কাগজে পাওয়া অ্যাকাউন্ট তথ্য যাচাই
কথায় আছে সাবধানের মাইর নেই তাই হাতের লেখায় বা SMS-এ প্রাপকের তথ্য ভুল হতে পারে। তাই যাচাইকৃত সোর্স বা অফিসিয়াল ডকুমেন্ট থেকে নেওয়া তথ্যই ব্যবহার করুন।

ভুল ফান্ড ট্রান্সফার হলে করণীয়

১. তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করুন
যদি বুঝতে পারেন আপনি ভুল অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছেন, তবে সাথে সাথেই আপনি যেই ব্যাংকের গ্রাহক সংশ্লিষ্ট সেই ব্যাংক বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS)-এর হেল্পলাইনে যোগাযোগ করুন। রেফারেন্স নম্বর বা লেনদেন আইডি হাতে রাখুন। কোন কোন গ্রাহক এ কাজটি না করে যেই ব্যাংকে টাকা পাঠিয়েছেন সেখানেই প্রথম যোগাযোগ করতে চায়। যা টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য ভুল পদ্ধতি।

২. লিখিত অভিযোগ দাখিল করুন
ফোনে সমাধান না হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে লিখিত বা ইমেইলে অভিযোগ দিন। অভিযোগপত্রে লেনদেনের তারিখ, সময়, অ্যাকাউন্ট নম্বর, পরিমাণ, রেফারেন্স নম্বর ও বিস্তারিত ঘটনা উল্লেখ করুন।

৩. প্রাপকের সম্মতি প্রয়োজন
ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী টাকা ভুল অ্যাকাউন্টে গেলে সেটা ফেরত আনতে প্রাপকের সম্মতি লাগে। অনেক সময় তিনি ফেরত দিতে রাজি না হলে, আইনি সহায়তার পূর্বে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ, ভুলের ব্যাখ্যা মানবিক দৃষ্টিকোণ ইত্যাদি বিষয়গুলো তুলে ধরুন। প্রয়োজনে মধ্যস্থতা ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করুন।

৪. ডরমেন্ট বা বন্ধ অ্যাকাউন্টে টাকা গেলে করণীয়
কোন কোন সময় ভুলবশত ফান্ড ট্রান্সফার এর টাকা অন্য ব্যাংকের বন্ধ, ইন-অপারেটিভ বা ডরমেন্ট অ্যাকাউন্টে চলে যায়। তখন ওই হিসাব থেকে সিস্টেম জেনারেট কিছু চার্জ বা অ্যাকাউন্ট মেইনটেনেন্স ফি এমনকি সরকারি ভ্যাট ও আবগারি শুল্ক হিসেবে কর্তন হয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন আলোচনা সাপেক্ষে কিছু সেক্রিফাইস হলেও দ্রুত সমাধানের জন্য সম্মতি জ্ঞাপন করা উচিত।

৫. বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ (যদি প্রয়োজন)
ভুল অ্যাকাউন্টে ফান্ড ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট কোন পলিসি নেই। কেবলমাত্র গ্রাহক ভুল করলে অভিযোগ অনুসারে নিরবচ্ছিন্ন গ্রাহক সার্ভিস ও ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ার প্রেক্ষিতে পর্যাপ্ত উপদেশ ও তদারকি করেন। আর গ্রাহকের অভিযোগ পরবর্তী তাদের চাহিদা অনুযায়ী উভয় ব্যাংক এর কর্মকর্তাগণ দ্রুত নিষ্পত্তিতে এগিয়ে আসেন।যদিও একেক ব্যাংকের সেটেলমেন্ট স্ট্রাটেজি ভিন্ন ভিন্ন রকমের।

ব্যাংক ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা

১. রিয়েল টাইম প্রাপক যাচাই সুবিধা
প্রাপক নাম পুরোপুরি দেখার সুবিধা থাকলে গ্রাহকের ভুল অ্যাকাউন্টে ফান্ড ট্রান্সফার হ্রাস পাবে। কিছু কিছু দেশে ব্যাংকগুলো ‘নেম ম্যাচিং অ্যালগরিদম’ ব্যবহার করে যা বাংলাদেশেও চালু হওয়া উচিত।

২. লেনদেন সতর্কতা বার্তা
লেনদেন নিশ্চিত করার আগে একটি সতর্কতামূলক বার্তা (যেমন: “আপনি যে অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে যাচ্ছেন তা যাচাই করুন”) গ্রাহকের ভুল ঠেকাতে সাহায্য করতে পারে।

৩. রিফান্ড প্রক্রিয়া দ্রুত, সহজ ও স্বচ্ছ করা
ভুল অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। তাই বর্তমানে ভুল লেনদেনে রিফান্ড প্রক্রিয়া ধীর ও জটিল থেকে সহজ, দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের আন্তরিক ইচ্ছা ও ইতিবাচক মনোভাব থাকা সত্ত্বেও লোক ও বলের অভাবে গ্রাহকের অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের সমাধান করতে হিমশিম খাচ্ছে। আর এ সমস্যা ইন্টারনেট ব্যাংকিং ফান্ড ট্রান্সফার চালু হওয়ার পর ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই গ্রাহকের কথা বিবেচনা করে একটি দ্রুত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া তৈরি করা দরকার যা গ্রাহকবান্ধব হবে।

প্রযুক্তির ব্যবহার: প্রতিরোধের সম্ভাবনা
১. AI ভিত্তিক রিস্ক ফ্ল্যাগিং
যদি কোনো অ্যাকাউন্টে আগে কখনো টাকা পাঠানো না হয় এবং আচরণ সন্দেহজনক হয়, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সতর্কতা জারি করা যেতে পারে।

২. ফেস বা ভয়েস অথেন্টিকেশন
বড় অঙ্কের লেনদেনে বায়োমেট্রিক যাচাই যেমন ফেস আইডি বা ভয়েস অথেন্টিকেশন চালু করলে নিরাপত্তা বাড়ে।

৩. ডুয়েল অথরাইজেশন
(বিশেষত কর্পোরেট ক্ষেত্রে)দুই ধাপে অনুমোদন থাকলে ভুল লেনদেনের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে।

সুতরাং ডিজিটাল অর্থ লেনদেন যত দ্রুত ও সহজ হয়েছে, ততই বেড়েছে অনিচ্ছাকৃত ভুলের ঝুঁকি। আমাদের মধ্যে অনেকেই প্রযুক্তিকে দায়ী করি, অথচ প্রকৃত চাবিকাঠি আমাদের হাতেই—সচেতনতা। একটু সাবধানতা, একটু সময় নিয়ে যাচাই—এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলোই পারে আমাদের কে বড় ধরনের ক্ষতি থেকে বাঁচাতে। তাই বলা যায়, ভুল লেনদেন প্রতিরোধের প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো সচেতন গ্রাহক। ব্যাংক, প্রযুক্তি বা আইন সহায়তা করলেও শেষ পর্যন্ত নিজের সুরক্ষায় নিজের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল যুগের স্মার্ট গ্রাহক হতে হলে এই সতর্কতাগুলো এখনই জানা ও মানা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক

মিজানুর রহমান

ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক

logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram