রাজধানীর মহাখালী মডেল হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মুনতাহা। প্রতিদিনই স্কুলে যায় সে। কিন্তু এক-দুটির বেশি ক্লাস হয় না। নতুন বছরে এখন পর্যন্ত পেয়েছে মাত্র দুটি বই। অথচ অষ্টম শ্রেণিতে এবার বইয়ের সংখ্যা ১৪টি। এখনো ১২টি বই হাতে পায়নি মুনতাহা ও তার সহপাঠীরা।
মুনতাহা রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) সকালে বলে, ‘২৩ জানুয়ারি আমাদের দুটি করে বই দিয়েছে। বাংলা ও ইংরেজি। এখনো গণিত বই পাইনি। বিজ্ঞানও দেয়নি। স্যারেরা গণিত ও বিজ্ঞানের পুরোনো বই কিনে নিতে বলেছেন। ওগুলো তো কঠিন…পড়তে দেরি হলে শেষ করতে পারবো না।’
একই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পাঁচটি এবং সপ্তমের শিক্ষার্থীরা তিনটি করে বই পেয়েছে। তাদেরও এখনো কারও আটটি, কারও ১০টি বই পাওয়া বাকি। বইগুলো কবে তারা হাতে পাবে, তা জানেন না শিক্ষকরাও।
শুধু মহাখালী মডেল হাই স্কুল নয়, ভিকারুননিসা নূন, মতিঝিল আইডিয়াল, মতিঝিল বালক উচ্চ বিদ্যালয়সহ রাজধানীর নামি প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিকের দুটি এবং মাধ্যমিকের চারটি শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও অর্ধেক বই পায়নি। ফলে রুটিন মেনে হচ্ছে না ক্লাস। বাড়িতেও পড়ালেখা করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। সবমিলিয়ে শিক্ষাবর্ষের প্রথম মাস শেষে ঢিমেতালে চলছে পড়াশোনা।
ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সব বই আমরা শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি। যেমন, দশম শ্রেণির বই আমরা অগ্রাধিকারভিত্তিতে ছেপেছি। কারণ তাদের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। দশমের সব বই আমরা ছাপিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছি।- এনসিটিবির বিতরক নিয়ন্ত্রক মো. হাফিজুর রহমান
শিক্ষকরা বলছেন, বই না পাওয়ায় ক্লাসে শিক্ষার্থীদের আনা যাচ্ছে না। যারা আসছে, তারাও অমনোযোগী থাকছে। বাড়িতেও তাদের পড়ার কিছু নেই। এভাবে চলতে থাকলে বড় ধরনের শিখন ঘাটতি নিয়ে পরবর্তী ক্লাসে উঠবে শিক্ষার্থীরা, যা তাদের শিক্ষাজীবনে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করবে।
শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই দেওয়া নিয়ে সরকারের এমন খামখেয়ালিপনায় ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা। কেউ কেউ বই কিনে সন্তানের হাতে দিতে পারলেও বেশিরভাগেরই সে সামর্থ্য নেই। তারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষাকে মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছে না। অথচ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে জীবন দিয়ে তাদের সরকারে বসিয়েছে। তাদের কল্যাণে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তথ্যমতে, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মিলিয়ে মোট ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে। তার মধ্যে এ পর্যন্ত ছাপা হয়েছে ২২ কোটি বই। সেগুলোর মধ্যে ১৮ কোটি বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছেছে। বাকি চার কোটি বই বিতরণ প্রক্রিয়াধীন।
অন্যদিকে এখনো ছাপানো বাকি প্রায় সোয়া ১৮ কোটি বই। সক্ষমতা অনুযায়ী—দিনে ৩৫ লাখ করে বই ছাপালেও তা শেষ করতে প্রায় দুই মাস লাগবে। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীদের সব বই হাতে পেতে এপ্রিল মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির বিতরক নিয়ন্ত্রক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত ১৪ কোটি ৪৭ লাখ ছাপা বই আমরা পেয়েছি। তার মধ্যে প্রায় ১২ কোটি বইয়ের ছাড়পত্র (পিডিআই) হয়েছে। অর্থাৎ, বইগুলো বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসে পাঠানো হয়েছে। তার মধ্যে কিছু বই এখনো পথে। বাকি বই স্কুলে স্কুলে পৌঁছে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সব বই আমরা শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি। যেমন, দশম শ্রেণির বই আমরা অগ্রাধিকারভিত্তিতে ছেপেছি। কারণ তাদের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। দশমের সব বই আমরা ছাপিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
প্রাথমিকের বই সবই হয়ে যেত। আমাদের ২৭টি লটের বই পুনঃটেন্ডার করতে হয়েছে। এ কারণে আমরা কিছুটা পিছিয়ে গেছি। তারপরও পাঁচমাসের কাজ আমরা আড়াই মাসে শেষ করেছি।- এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক আবু নাসের টুকু
এদিকে, প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই ৯০ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে যে ২৮ লট বই ছাপা হচ্ছে তার ৮২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। তবে প্রাথমিকের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বই ছাপাতে আরও দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। ফলে প্রাথমিকের সব বই পৌঁছাতে ফেব্রুয়ারির ২২-২৫ তারিখ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
প্রাথমিকের বই দেখভাল করে এনসিটিবির উৎপাদন শাখা। উৎপাদন নিয়ন্ত্রক আবু নাসের টুকু বলেন, ‘প্রাথমিকের বই সবই হয়ে যেত। আমাদের ২৭টি লটের বই পুনঃটেন্ডার করতে হয়েছে। এ কারণে আমরা কিছুটা পিছিয়ে গেছি। তারপরও পাঁচ মাসের কাজ আমরা আড়াই মাসে শেষ করেছি।’
পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ঢাকা থেকে যে তথ্য দিচ্ছে, তার সঙ্গে মিলছে না জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসের তথ্য। কারণ বইয়ের ছাড়পত্র দেওয়ার পর ধীরগতিতে জেলা ও উপজেলায় বই পাঠানো হচ্ছে। কোনো কোনো উপজেলায় পাঠানো হচ্ছে সপ্তাহে একদিন। বই পেতে চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকছেন শিক্ষা কর্মকর্তারা।
কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, এবার জেলায় মাধ্যমিকের (ষষ্ঠ-দশম) বইয়ের চাহিদা ৩১ লাখ ৩৭ হাজার ১৫৫ কপি। গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সেখানে বই পৌঁছেছে মাত্র ১০ লাখ ৭৯ হাজার ৭৯৪টি। তার মধ্যে তারা বিতরণ করতে পেরেছেন ৯ লাখ ১২ হাজার ৮৮টি বই।
মাদরাসায় দাখিল পর্যায়ে (ষষ্ঠ-দশম) বইয়ের চাহিদা ১৮ লাখ ৩৯ হাজার ৩৫৪ কপি। জেলায় পৌঁছেছে মাত্র ২ লাখ ৮৮ হাজার ৪৯৮ কপি। বিতরণ করা হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ২৩৭টি বই। এছাড়া ভোকেশনালের শিক্ষার্থীদের জন্য কুড়িগ্রাম জেলায় বই প্রয়োজন ২ লাখ ১৬ হাজার ১৪৪ কপি। কিন্তু জেলায় বই পাঠানো হয়েছে মাত্র ৭৫ হাজার ৯১২টি।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শামছুল আলম বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে বই আসছে। দ্রুত আমরা সেগুলো উপজেলা পর্যায়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ধাপে ধাপে বই আসায় বণ্টন করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।’
খাগড়াছড়ি জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, এবার ষষ্ঠ-দশম শ্রেণির জন্য জেলাটিতে বইয়ের চাহিদা ২৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭৫৫টি। ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত সেখানে বই গেছে মাত্র ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৪৬৪টি। একই জেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানায়, চলতি বছর জেলায় প্রাথমিকে বইয়ের চাহিদা ছিল চার লাখ ৩৬ হাজার। পৌঁছেছে ২ লাখ ১৪ হাজার বই।
মহাখালী মডেল হাই স্কুলে প্রাথমিকের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস হচ্ছে। চতুর্থ-পঞ্চম এবং মাধ্যমিকের ক্লাস চলছে কোনোমতে। বই না পাওয়ায় ক্লাসে বসতে চায় না শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে বিরক্ত শিক্ষকরাও।
স্কুলটির শ্রেণি শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের পিডিএফ ডাউনলোড করে ফটোকপি করতে বলেছিলাম। কেউ করছে, কেউ করেনি। ক্লাসে ডাকলেও আসে না। স্কুলে এসে খেলাধুলা করে বাসায় চলে যেতে চায় ওরা। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। তবে সব বই না পাওয়া পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসে ফেরানো কষ্টসাধ্য হবে।’
শিক্ষার্থীদের পিডিএফ ডাউনলোড করে ফটোকপি করতে বলেছিলাম। কেউ করছে, কেউ করেনি। ক্লাসে ডাকলেও আসে না। স্কুলে এসে খেলাধুলা করে বাসায় চলে যেতে চায় ওরা। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। তবে সব বই না পাওয়া পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসে ফেরানো কষ্টসাধ্য হবে।- শ্রেণি শিক্ষক জাকির হোসেন
চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩ হাজার ২৮৩ জন। এর মধ্যে প্রাথমিকে ২ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ জন এবং মাধ্যমিকে ২ কোটি ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮০৪ জন। প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী সব বই পেয়েছে। সেই হিসাবে সব বই হাতে পাওয়া থেকে বঞ্চিত শিক্ষার্থী প্রায় ৩ কোটি।
যাদের পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল, তারা বিকল্প উপায়ে (পুরোনো বই কেনা ও পিডিএফ প্রিন্ট) পড়াশোনা করছে। তবে অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিকল্প ব্যবস্থা করতে সক্ষম নয়। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনায় বৈষম্যও তৈরি হচ্ছে। এতে মেধাবী হওয়ার পরও বই না পেয়ে ভুক্তভোগী হচ্ছেন বহু শিক্ষার্থী।
এ প্রসঙ্গে ইস্কাটন গার্ডেন উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা বলেন, ‘আমার স্কুলে তিনটি শ্রেণিতে আমি ক্লাস নিই। হাতে গোনা কয়েকজন পিডিএফ ফটোকপি করে নিয়ে আসে। দু-একজন পুরোনো বই কিনেছে। অন্যদের হাতে বই নেই। এভাবে ক্লাস করাতে থাকলে বৈষম্য বাড়বে। শহরের অবস্থা যদি এমন হয়, গ্রামের অবস্থাটা ভাবুন! যাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো, তারা বিকল্প ব্যবস্থা করছে। যারা করতে পারছে না, তারা পিছিয়ে পড়বে।’
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীর মা তাহেরা আক্তার রূপা। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে তিনটি বই পেয়েছে। বাংলা, ইংরেজি, গণিত। স্কুল থেকে বলার পর পুরোনো বিজ্ঞান বইটা আমরা কিনে দিয়েছি। চারটা বই মেয়ের হাতে। ১৩-১৪টি বই এবার। এখনো ১০টা বইয়ের খোঁজ নেই। বাধ্য হয়ে ওগুলোই ঘুরেফিরে পড়ছে মেয়েটা। কিন্তু ক্লাস তো হচ্ছে না। পড়ালেখার অনেক ক্ষতি হচ্ছে।’
সোয়া ১৮ কোটির বেশি বই ছাপানোর বাকি। সেগুলো ছাপানোর পর বিতরণেও অন্তত দেড় সপ্তাহ লেগে যায়। এমন বাস্তবতা সামনে রেখেও আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান।
তিনি বলেন, প্রাথমিকের শতভাগ বই চলতি সপ্তাহে হয়ে যাবে। দশম শ্রেণির বইয়ের কাজ শেষ। বাকি শ্রেণির বইগুলো আমরা ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দেওয়ার চেষ্টা করছি। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির সব বই ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। তাছাড়া নবম শ্রেণির বই বেশি হওয়ায় একটু দেরি হবে। সেটাও ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হয়ে বলে বলে আশা করছি।’
তবে এনসিটিবি চেয়ারম্যানের এ বক্তব্য আকাশ-কুসুম চিন্তা ছাড়া কিছুই না বলে মনে করেন ছাপাখানার মালিকরা। তাদের প্রশ্ন, ১৭-১৮ কোটি বই উনি (এনসিটিবি) ১০ দিনে ছাপাবেন কোথায়?
নবম শ্রেণির বই ছাপার কাজ করা একজন ছাপাখানার মালিক নাম প্রকাশ না করে সোমবার সকালে বলেন, ‘চেয়ারম্যান সাহেব প্রথমে বলেছিলেন জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সব বই হয়ে যাবে। পরে বললেন ১৫ তারিখের মধ্যে সব দিয়ে দেবো। জানুয়ারি চলে গেলো… এখন ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখের টাইমলাইন দিলেন। এগুলো অবাস্তব কথা গণমাধ্যমে কেন বলছেন, তা জানি না।’
তিনি বলেন, ‘আমরার মতে, পুরো ফেব্রুয়ারি মাস কাজ করলেও বই শেষ নামানো (ছাপানো) কষ্টসাধ্য। তারপরও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ ধরে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। মার্চে রোজা শুরুর আগে আমাদের দিক থেকে ছাপানো শেষ করতে চাই। তবে বিতরণ শেষ করতে আরও কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে।’