ঢাকা
১৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
সকাল ৮:১১
logo
প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৩, ২০২৫

দেশের ৪১ জেলায় শীত নিবারণে যাচ্ছে কাজিপুরের কম্বল

আবদুল জলিল, কাজিপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি: সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার ছালাভরা গ্রামের ওমিছা, আচফুল, সুকবালা, ছামিরণ, শেফালি, রেজিয়ারা ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রতিজনের জীবনের গল্প অবশ্য আলাদা। কিন্তু শীত বাড়ার সাথে সাথে তাদের হাতের সেলাই মেশিনের চাকাও ঘোরে সমানতালে। তাদের মেশিনের প্রতিটি সেলাইয়ের ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের জীবনের সমৃদ্ধির গল্পও তারা রচনা করে চলেছেন।

ওমিছার প্রতিবেশি জমিরনের রিক্সা শ্রমিক স্বামীর একার আয়ে চলা কঠিন। দুই ছেলে স্কুলে পড়ে। মেয়েটাকে এবার স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। অনেক খরচ। তাই স্বামীকে সহায়তা করতে বছরের আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করে ঝুট থেকে কম্বল তৈরির কাজে। এতে করে মাসে তার দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা আয় হয়। এমনি করে সবার গল্প আলাদা হলেও নিজেদের জীবনের সংগ্রামী ইনিংসটাকে এগিয়ে নিতে তারে ভরসা জোগাচ্ছে ঝুট কম্বল শিল্প।

উপজেলার শিমুলদাইড় বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে এই ঝুট পল্লী। আশপাশের ছালাভরা, কুনকুনিয়া, বর্শিভাঙ্গা, সাতকয়া, বিলচতল, ঢেকুরিয়া, পলাশপুর, বেলতৈল, শ্যামপুর, কবিহার, চালিতাডাঙ্গাসহ প্রায় তেত্রিশটি গ্রামের ৩৬ থেকে ৪০ হাজার নারী ও পুরুষ এই শিল্পে কাজ করেন। এই কাজের মাধ্যমে এলাকার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে দ্রুত। এককালের ছনের ঘর বিদায় নিয়েছে এই এলাকা থেকে এক সময়ের ভিক্ষার এখন কর্মের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুর রাজ্জাক জানান, বছরের শীতের সময়ে যখন ক্লাস বন্ধ হয়ে যায় তখন বাড়ি এসে ঝুট কম্বলের কাজ করি। এতে করে আমার হাত খরচ বেশ চলে যায়। শিমুলদাইড় বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী জয়িতা আহমেদ জানান, স্কুল থেকে এসে মায়ের সাথে ঝুট সেলাই করি। এতে করে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা পাই। আমার প্রাইভেট পড়ার খরচ আমি এভাবেই জোগাড় করছি।

তিনযুগ আগের কথা। বিকল্প উপার্জনের পথ বাছতেই একদিন বড়শীভাঙ্গার ছাইদুল হক চলে যান ঢাকার মিরপুরে। তার পছন্দের তালিকায় চলে আসে ঝুটকাপড় কিনে এনে তা সেলাই করে তৈরি করেন কম্বল। সাইকেলের পেছনে তুলে বিক্রি শুরু হয় গ্রামে গ্রামে। হাতে আসে অনেক টাকা। বদলাতে থাকে ছাইদুলের জীবন। এমনি করে হাজী জিয়া, চান মিয়া, মনির হোসেনরা শুরু করেন এই ব্যবসা। এরপর ২০১৪ সালে শরিফ সোহেল এই ব্যবসায় আসলে দ্রুত পাল্টে যায় ব্যবসার ধরন। তিনি একে একে কম্বলের ধরণ বাড়াতে থাকেন। তারপর থেকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি এ তল্লাটের মানুষের।

ঝুট মানে গার্মেন্টসের ফেলে দেয়া ঝুট কাপড় বিশেষ কায়দায় সেলাই করে তৈরি করা হয় কম্বল। পুরুষের পাশাপাশি বাড়ির মহিলারাও সেলাই করেন। শুরু হয় সেলাই বিপ্লব। আর এই বিপ্লবের ৮০ ভাগ কারিগর হলো মহিলারা। সংসারে তাদের একটা আলাদা অবস্থান তৈরি হয়েছে।

কাজিপুরের এই ঝুট পল্লীতে শুরুতে শুধুমাত্র জোড়া কম্বল তৈরি হলেও সময়ের সাথে সাথে পাল্টেছে এর ধরণ। এখন শিশু পোশাকসহ ১৬১ প্রকারের কম্বল প্রস্তুত হচ্ছে। সরাসরি চায়না থেকে কম্বল এখানে আসছে। সেইসাথে এবার শরিফ সোহেল নিজে কম্বল তৈরির কারখানা চালু করেছেন। সুতা এনে নিজেই তৈরি করছেন কম্বল। দামের ক্ষেত্রে আছে রকম ফের। এখানে শুধু আশি টাকা থেকে পৌণে ছয় হাজার টাকায় কম্বল বিত্রি করা হয়। শিশুদের জন্যে একটি পায়জামা ১২ টাকা থেকে দুশো টাকা এবং জামা ৩০ টাকা থেকে চারশ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।

বর্তমানে একটি চার হাত দৈর্ঘ্য ও পাঁচ হাত প্রস্থের লেপ বানাতে এক হাজার দুশো থেকে থেকে দুই হাজার টাকা লাগে। অথচ একই সাইজের একটি ঝুট কম্বল একশ থেকে তিনশ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। ঝুট কাপড়ে বেশি জোড়া পড়লে প্রায় ৫ কেজি ঝুটে একটি কম্বল তৈরি করা যায়। গত বছর এই ঝুট প্রতি কেজি ১৭ থেকে ২২ টাকায় কেনা যেত। কিন্তু বর্তমানে ৩০ থেকে ৩৩ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গরমের সময় প্রতি কম্বলের মজুরি ৩৫ টাকা এবং শীতের সময় ৩৫ থেকে ৫০ টাকা। নারী শ্রমিকরা গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসব কম্বল সেলাই করেন।

ঝুট ব্যবসায়ী সংগঠনের সাবেক সভাপতি শরিফ সোহেল জানান, ঝুট কম্বলের জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেই সাথে এর চাহিদা এখন বলতে গেলে সারা দেশব্যাপী। গত দুই বছর কাজিপুর উপজেলার ইউএনও আমাদের তৈরি কম্বল দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে সকল ইউএনও, ডিসিদের পত্র প্রেরণ করেছিলেন। এর ফলে দেশের নানা প্রান্ত থেকে এখন আমাদের অর্ডার আসে।

তিনি জানান, বছরের অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দিনে প্রায় কোটি টাকার কম্বল এই বাজার থেকে দেশের নানা প্রান্তে সরবরাহ করা হয়। তবে এখন কাঁচামালের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ঝুট কাপড় ভারতে যাওয়ার কারণে এখন বেশি টাকা দিয়েও চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। সরকার এই অঞ্চলকে ঝুটপল্লী (বিসিক শিল্প নগরী) হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সহজ শর্তে ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রদানের ব্যবস্থার করার তিনি দাবি জানান।

কাজিপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেওয়ান আকরামুল হক জানান, সারাদেশে শিমুলদাইড় বাজারের নাম ছড়িয়ে পড়েছে ঝুটশিল্পের কারণে। ঝামেলামুক্ত পরিবেশে শ্রমিকেরা এখানে কাজ করছেন দিনরাত। তাদের যাপিত জীবনে এসেছে পরিবর্তন। প্রতিটি পরিবারেরই এখন একটি কমন গল্প রয়েছে। সেই গল্পের শিরোনাম কেবলই সমৃদ্ধির, কেবলই উন্নতির।

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram