মো. নাসির উদ্দিন, টাঙ্গাইল: নদী বিধৌত টাঙ্গাইলের চরাঞ্চালের মানুষের পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারী ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট বর্তমান টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩ শত ৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটির জনবল সংকটে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। চিকিৎসক, নার্স, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী সহ জনবলের অভাবে কাঙ্খিত স্বাস্থ্য সেবা হতে বঞ্চিত টাঙ্গাইলের প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ। চাহিদা অনুযায়ী জনবল চেয়ে মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হলেও কোন সুফল পাওয়া যায়নি।
২০১৪ সালে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৫তলা ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করে গণপূর্ত বিভাগ। ২০১৮ সালের শেষ দিকে ভবন নির্মাণ শেষ হয়। ২০২২ সালের ২২ মার্চ হাসপাতাল ভবন কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দেয় গণপূর্ত বিভাগ। এছাড়াও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার কারণে জেলায় অবস্থিত ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে সবসময়ই রোগীর চাপ থাকে। কিন্তু জেনারেল হাসপাতালে উন্নতমানের যন্ত্রপাতি না থাকায় রোগীদের উন্নত চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয় না। তাই জরুরি রোগী রেফার করতে হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যে কারণে সরকার এসব মানুষের উন্নত চিকিৎসা সেবা দেয়ার লক্ষ্যে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের আন্তঃবিভাগে মেডিসিন, শিশু, ডায়রিয়া, কার্ডিওলোজি, অবস(গাইনী), চক্ষু, নাক, কান, গলা, পোস্ট অপারেটিভ, আইসিইউ, সিসিইউ, সার্জারী, অনক্লোনজি ও অর্থপেডিক ওয়ার্ড চালু রয়েছে। হাসপাতালের বহিঃবিভাগে মেডিসিন, শিশু, গাইনী, সার্জারী, চক্ষু, ডেন্টাল, বক্ষব্যাধি, নিউরোলজি, ইউরোলজি, মানসিক, শিশু বিকাশ কেন্দ্র, ফিজিক্যাল মেডিসিন, চর্ম ও যৌন, কার্ডিওলজি, নেফরোলজি, অর্থপেডিক, অনক্লোনজি(ক্যান্সার) সেবা চালু রয়েছে। রোগ সনাক্তের জন্য অত্যাধুনিক আল্ট্রাসনোগ্রাফি, ইসিজি, সিটিস্ক্যান, এক্সরে সহ বিভিন্ন পরীক্ষা শুরু করা হয়েছে। ১০টি আইসিইউ বেড, সিসিইউ ও ১৫টি অপারেশন থিয়েটার কাঙ্খিত সেবা প্রদানের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, শুধুমাত্র জনবল সঙ্কটের কারণে হাসপাতালের কাঙ্খিত স্বাস্থ্য সেবা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতালে ১ জন পরিচালক, ১ জন উপ পরিচালক ও ১ জন সহকারী পরিচালক কর্মরত আছেন। এছাড়া আরপি/আরএস ৫ জন প্রয়োজন, আছেন ৪ জন। সহকারী র্সাজন ৫৫ জনের বিপরীতে র্কমরত আছেন ৪৭ জন। শূণ্যপদ ৮ টি পূরণের পরেও অতিরিক্ত আরো ৪০ জন সহকারী সার্জনের প্রয়োজন রয়েছে হাসপাতালটিতে। এনেসথেসিওলজিস্ট কর্মরত আছেন ৩ জন, আরো ১জন প্রয়োজন। ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট ১ জন কর্মরত আছেন, প্রয়োজন আরো ২ জন। ডেন্টাল সার্জন ৪ জনের মধ্যে ২ জন কর্মরত আছেন। নার্স সুপারভাইজার ৮ টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ১ জন। সিনিয়র স্টাফ নার্স ১৬৫ টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ১০৬ জন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ২ টি পদের বিপরীতে ১ জন কর্মরত। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর শূণ্যপদ ৩৫ টি। আউটসোর্সিং জনবল ৯০ জন, আরো ৫৭ জন নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। যারা কর্মরত আছেন তারাও নিয়মিত কর্মস্থলে থাকেন না। অনেকে ঢাকা থেকে এসে অফিস করেন। আয়া, সুইপার ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীর অভাবে হাসপাতালের ময়লা-আবর্জনা পরিস্কার করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ওয়ার্ডের ময়লা-আবর্জনা রোগীদের পাশেই রাখা হচ্ছে। দুর্গন্ধে শৌচাগারে প্রবেশ করা যায় না। প্রকট জনবল সমস্যার কারনে কাঙ্খিত সেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না।
টাঙ্গাইলের বিভিন্ন উপজেলা হতে আগত রোগী শাহনেওয়াজ, রওশনারা, মতিয়ারসহ স্বাস্থ্য সেবা নিতে আসা একাধিক রোগী জানান, টাঙ্গাইলের গণমানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে টাঙ্গাইলে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। শুধুমাত্র জনবল সঙ্কটের কারণে তারা কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেন না। ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় গিয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত ব্যয় সহ নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তারা হাসপাতালে দ্রুত পূর্নাঙ্গ চিকিৎসা সেবা চালুর দাবি জানান।
রোগীদের অভিযোগ, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে পাঁচটি ওষুধ দিলে একটি ঔষুধ পাওয়া যায়। বাকি ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। হাসপাতালে ঔষুধ থাকলেও প্রায় সময় রোগীদের ঔষুধ দেওয়া হয় না। ডিজিটাল এক্সেমেশিনসহ ল্যাবে আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও জনবল সংকটের কারনে কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রোগীরা। টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ ঘিরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ক্লিনিক। হাসপাতাল চত্বরে ঘোরাফেরা করা দালালরা তাদেরই কমিশন ও বেতনভুক্ত। সরকারি হাসপাতালে এসেই দালালদের খপ্পরে পড়েন গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল রোগী ও তাদের আত্মীয়রা। কোনো কোনো দালাল আবার গ্রাম থেকে আসা নিরক্ষর মানুষজনকে ভুলভাল বুঝিয়ে হাসপাতালের ভেতর পর্যন্ত আসতেই দেন না। বাইরে থেকেই রোগীদের নিয়ে যান বিভিন্ন ক্লিনিকে। বিভিন্ন প্রলোভনে দালালরা তাদের আশপাশের ক্লিনিক গুলোতে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া চত্বরে জটলা পাকিয়ে আছেন বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির বিপণন প্রতিনিধিরা। রোগীরা চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হওয়া মাত্রই আশপাশের ওষুধের দোকানদার বা ওষুধ কোম্পানির লোকজন প্রেসক্রিপশন নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করেন। মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালটিতে জরুরী রোগী পরিবহনের জন্য কোন অ্যাম্বুলেন্স নেই। ব্যয়বহুল ভারতীয় অ্যাম্বুলেন্সটি অলস অবস্থায় পড়ে রয়েছে দীর্ঘদিন। তাই ভাড়াটে অ্যাম্বুলেন্স চালকদের দৌরাত্ম্য চোখে পড়ার মতো।
স্থানীয়রা জানায়, টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ করা হলেও পুরোপুরি চিকিৎসা সেবা শুরু না হওয়ায় টাঙ্গাইলের ৪০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রোগীদের ঢাকাসহ আশপাশের বিভাগীয় শহর থেকে কাঙ্খিত সেবা নিতে হচ্ছে। ফলে আশঙ্কাজনক রোগী ও স্বজনরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পুরোপুরি মানসম্মত চিকিৎসা সেবা চালু করার দাবি জানায়।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ভবনের লিফট ও আশপাশের দেওয়ালে পানের পিক ফেলে পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। ধুলাবালির কারণে ভবনের বিভিন্ন জানালার গ্রীলে মরিচা ধরতে শুরু করেছে। ওয়ার্ডে বরাদ্দ বিছানার বাইরেও অতিরিক্ত শতশত রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রোগীদের বিছানার পাশে ও শৌচাগারসহ বিভিন্ন কক্ষের সামনে ময়লা-আবর্জনা পড়ে রয়েছে। উৎকট দুর্গন্ধে শৌচাগার ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
নারী ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, নির্ধারিত বিছানার পাশাপাশি মেঝেতে বিছানা পেতে নারী রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সেখানেও ময়লা-আবর্জনার একই চিত্র বিদ্যমান। হাসপাতাল পরিচালকের কক্ষসহ বিভিন্ন দেওয়ালের টাইলস খসে পড়ছে। অভিযোগ উঠেছে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের।
শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. আব্দুল কদ্দুস জানান, হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবা পুরোপুরি চালু করতে পর্যাপ্ত জনবলের প্রয়োজন। জনবলের জন্য মন্ত্রণালয়ে বার বার চিঠি দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি সবই আছে। কিন্তু জনবলের অভাবে পুরোপুরি স্বাস্থ্য সেবা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘পর্যাপ্ত জনবল ও লজিস্টিক সরবারাহ পেলে আমরা কাঙ্খিত সেবা দিতে পারব। ডাক্তার, পর্যাপ্ত নার্স, সাপোর্টিং স্টাফ না থাকায় পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। আয়া এবং ওয়ার্ড বয় না থাকায় কী যে কষ্ট তা বুঝানো সম্ভব নয়।