গোপাল অধিকারী, ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি: পাবনা সদর ও ঈশ্বরদী উপজেলার মাঝামাঝি ইউনিয়ন লক্ষ্মীকুন্ডা। শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ৫০.৬৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ইউনিয়নে ২২ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। কৃষি এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশা। উপজেলার সবচেয়ে বেশি সবজিও উৎপাদন হয় এখানে। সেই কৃষি আবাদের শত শত একর ফসলি জমি নষ্ট করে এ ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে অবৈধ অর্ধশতাধিক ইটভাটা।
পদ্মা নদীঘেঁষা এই ইউনিয়নটি জেলার অন্য জায়গা থেকে তুলনামূলক নির্জন। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। একটি-দুটি নয়, ৫৭টি ইটভাটা নির্মাণ করে দিন-রাত সমানতালে তারা কাঠ পুড়িয়ে ইট বানাচ্ছেন। এসব ইটভাটার জন্য ফসলী জমি কমে যাওয়া ও ইটভাটা থেকে পরিবেশ বিনষ্টকারী ধোঁয়া নির্গত হওয়ার কারণে লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নে সবজি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়েছে। বিষয়টি চরমভাবে ভাবিয়ে তুলেছে স্থানীয় কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের।
স্থানীয়রা বলছেন, মাঝে-মধ্যে পুলিশ-প্রশাসনের গাড়ি এসে অভিযান চালায়। তারা চলে যাওয়ার পরই আবারও ভাটা মালিকরা ইট পোড়াতে শুরু করতেন। কেনইবা তারা আসতেন, আর কেনইবা ইটভাটা আবার চালু হতো তা নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এর পেছনের কারণও তারা খুঁজে পান না। তবে পরে অভিযান একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। হয়তো প্রভাবশালীদের ছায়া থাকার কারণে ইটভাটা মালিকদের কেউ কিছু করতে পারেন না। খোদ পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তার মতে, জেলার সবচেয়ে বেশি ইটভাটা রয়েছে এই ইউনিয়নে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘ভাটার আশপাশে ইট তৈরির মাটি ও আগুন জ্বালানোর কাঠ কম দামে পাওয়া যায়। ইটের চাহিদা থাকা ও লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় ধীরে ধীরে এই এলাকায় ইটভাটার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক এক করে এই ইউনিয়নে ইটভাটার সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৭টিতে। সবই গড়ে উঠেছে ফসলি জমির ওপর। কোনোটিরই বৈধ কাগজপত্র নেই।’
এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই ভাটা মালিকরা ইট পুড়িয়ে যাচ্ছেন। কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করায় নির্গত হওয়া কালো ধোঁয়ায় এলাকার পরিবেশ নষ্ট করছে। ক্ষতি হচ্ছে শাক-সবজির পাশাপাশি ফলদগাছের।
দাদাপুর গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ইটভাটার পাশের একটি জমিতে কফি, পেঁপে ও গাজর লাগিয়েছি। ইটভাটার ধুলার কারণে সে কফি ও পেঁপের পাতায় ধুলার আস্তরণ পড়েছে, আর গাজরের গাছ বাদামি রং ধারণ করেছে। ইটভাটার কারণে তার জমিতে কয়েকবার ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতিবাদ করে কাজ না হওয়ায় বাধ্য হয়ে ইটভাটার মালিকের কাছে কম দামে সেই জমি বিক্রি করে দিয়েছি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মিতা সরকার বলেন, ‘লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নে অসংখ্য ইটভাটা গড়ে ওঠায় সেখানকার কৃষি জমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। কাঠ পোড়ানো কালো ধোঁয়া ও ছাইয়ের কারণে শাক-সবজিসহ আম, লিচু, কাঁঠালগাছের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। অবিলম্বে এ কার্যক্রম বন্ধ হওয়া দরকার।’
পরিবেশ অধিদপ্তর পাবনা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নাজমুল হোসাইন, ‘ঈশ্বরদীর অধিকাংশ ইটভাটাই রয়েছে এক ইউনিয়নে।’ এসব ইটভাটার ছাড়পত্র রয়েছে কি না জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘চারটি বাদে বাকিগুলো ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অভিযানের পর যে ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেটা আবার চালু হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর শুধু ছাড়পত্র দেয়, জেলা প্রশাসন ইট পোাড়নোর অনুমতি দিয়ে থাকে।’
ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুবীর কুমার দাশ বলেন, লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নে যেসব ইটভাটা রয়েছে তা সরকারি খাস জমির পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতেও স্থাপন করা হয়েছে। বিষয়টি যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলমান রয়েছে। অনিয়ম করে কেউ ইটভাটা চালালে ছাড় দেওয়া হবে না।