দেশের প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের নিরাপত্তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। সেখানকার ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরাগুলোর অনেকগুলোই নষ্ট হওয়ায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার প্রকৃত চিত্র পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
সচিবালয়ে প্রবেশমুখের একটি ভবনের দোতলায় রয়েছে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার মনিটর ব্যবস্থা। সেটি মনিটরিংয়ের প্রকৃত দায়িত্ব কার তা এখনো পরিষ্কার হওয়া যায়নি।
পুলিশ বলছে দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পুলিশের। পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, সচিবালয়ের নিরাপত্তা বিষয়টি মনিটরিং করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা শাখা। পুলিশ তাদের সহযোগিতা করে। ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরাগুলো নষ্টের বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হলেও গা করে না সংশ্লিষ্ট দপ্তর।
সূত্র জানায়, সচিবালয়ের পাঁচটি গেটসহ প্রতিটি ভবনের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের বরান্দায় ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা রয়েছে। শত শত ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসানো হলেও সেগুলোর অনেকগুলো নিম্নমানের হওয়ায় নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।
একটি সূত্রের দাবি, সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতা কি না, তার তদন্তে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় ধারণ করা চিত্র গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। এরই মধ্যে গত বুধবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পুরো সচিবালয়ে কারা যাতায়াত করেছেন, কারা কোথায় গেছেন, সেই ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সচিবালয়ের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখা এসবি। তবে এসবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল রাতে জানান, ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার মনিটরিংয়ের দায়িত্ব এসবির নয়। এসবি গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে।
ডিএমপির প্রটেকশন অ্যান্ড ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি বিভাগের যুগ্ম কমিশনার সানা শামিনুর রহমান বলেন, ‘এই মুহূর্তে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি বিষয়টি তদন্ত করছে।
সচিবালয়ের মোট ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরাগুলোর মধ্যে কতটি নষ্ট এ বিষয়ে জানতে সচিবালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব তোফায়েল হোসেনকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
এদিকে গতকাল শনিবার সচিবালয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেছে। বৈঠকে অগ্নিকাণ্ডের সময় দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ জন্য গতকাল সকাল থেকে সচিবালয়ে ছিল কড়া নিরাপত্তা।
গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, সচিবালয়ের মূল গেট ছাড়া অন্য সব গেট বন্ধ। তবে সব প্রবেশমুখেই ছিল কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা। মূল গেটের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার, এপিবিএনসহ সব গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা মোতায়েন ছিলেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন এমন একজন কর্মকর্তা জানান, সচিবালয়ে কোনো গাড়ি প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। মূল প্রবেশপথের বাইরে গাড়ি রেখে সচিবালয়ে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
কড়া নিরাপত্তার মাঝে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যসহ সচিবালয়ে কর্মরত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সচিবালয়ের ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। বিকেলে তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে গাড়ি প্রবেশ করতে দেখা যায়। এ সময় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন কর্মরত পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তা কর্মী, ফরাস (তালা লাগানোর দায়িত্বে নিয়োজিত) ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সচিবালের ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। গতকাল বৈঠক শেষে তদন্ত কমিটির কোনো সদস্য মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানান, ঘটনার সময় দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। যেসব ব্যক্তি গেটে তালা লাগানোর কাজে নিয়োজিত ছিলেন তাঁদের কাছ থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিষয়গুলো জানা হয়েছে। কারণ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানিয়েছেন, কলাপসিবল গেটের ভেতরে-বাইরে ছিল তালা। এতে আগুন নেভাতে বেশি সময় লেগে গেছে।
তিনি বলেন, সচিবালয়ের রহস্যজনক আগুন নেভাতে অনেক সময় লেগে গেছে। আগুন নেভাতে কেন বেশি সময় লেগেছে তার কারণ জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে একজন ফরাস বলেন, ‘আমরা শুধু রুমের তালা বন্ধ করি। কলাপসিবল গেটের তালা বন্ধ করেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক শাখার কর্মচারীরা। প্রতিদিন সকালে কলাপসিবল গেটের তালা খোলার পর আমরা কাজ শুরু করি। আবার আমরা সব রুমের তালা বন্ধ করার পর কলাপসিবল গেটের তালা বন্ধ করা হয়। তবে অনেক সময় কলাপসিবল গেটের তালা খোলাও থাকে।’
অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরির ক্রাইম সিনের একটি ভ্যান গতকাল বিকেলে সচিবালয়ের ঘটনাস্থলে গেছে।
সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে আমাদের ক্রাইম সিন ও ফরেনসিক টিম ঘটনাস্থলে কাজ করছে। আমরা বেশ কিছু আলামত সংগ্রহ করেছি। এ বিষয়ে মামলা হলে তদন্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে বাকি সব কিছু জানা যাবে। এর বাইরে বর্তমানে আর বেশি কিছু বলতে পারছি না।’
পাঁচ মন্ত্রণালয়ের কাজ চলবে অস্থায়ী দপ্তরে
সচিবালয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সচল রাখতে অস্থায়ী দপ্তরে আজ রবিবার থেকে কাজ শুরু হবে। এসব মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সংস্থাগুলোর কার্যালয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে দাপ্তরিক কাজ পরিচালিত হবে।