দেশের জাতীয় বাজেট বাস্তবায়ন একই জায়গায় আটকে আছে। প্রতিবার বাজেট ঘোষণার পর তা সংশোধন করে আকার ছোট করা হলেও পুরো অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়নের হার কমে যাচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ১০ বছরের তথ্য অনুযায়ী, বাজেট বাস্তবায়নের গড় হার ৮০-৮৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ বাজেটের অর্থ ব্যয় করতে পারছে না সরকার। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট আগেভাগেই সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে উন্নয়ন বাজেটের আকার কমিয়ে ভর্তুকির বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। খবর অর্থ বিভাগ সূত্রের।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্যমতে, এডিপি বাস্তবায়নের হার এ বছর প্রথম পাঁচ মাসে ১২ দশমিক ২৯ শতাংশে নেমে এসেছে, যা এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত অর্থবছরের একই সময়ে বাস্তবায়নের হার ছিল ১৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ এবং তার আগের অর্থবছরে ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত এক দশকে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ছিল ২০১৫-১৬ অর্থবছরে, ওই বছর এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ১৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। সরকারি সংস্থাগুলো গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় করেছিল ৪৬ হাজার ৮৫৭ দশমিক ৩৮ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের ব্যয় হয়েছে ৩৪ হাজার ২১৪ দশমিক ৫৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সরকারের এডিপি বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ দশমিক ৯০ কোটি টাকা।
গত বছরের তুলনায় উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় কমায় এবার প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা অব্যবহৃত থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মূলত সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়নের কথা বলে প্রচুর প্রকল্প নিয়েছিল, এগুলোর বরাদ্দ দিতে তখন সরকারে আর্থিক চাপ তৈরি হয়। এজন্য এবার অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেবে সরকার। তাই বছর শেষে এডিপিতে বরাদ্দের প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা অব্যবহৃত থেকে যেতে পারে। উন্নয়ন ব্যয় অনেক কম হবে বিধায় বকেয়াসহ চলতি অর্থবছরের পুরো ভর্তুকি পরিশোধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী ২০২৬-২৭ অর্থবছরের মধ্যে সার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বকেয়া ভর্তুকি পরিশোধ করতে হবে। ফলে সরকার ভর্তুকিতে বরাদ্দ বাড়াবে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে সার ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ভর্তুকির বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হচ্ছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ, সার ও জ্বালানি খাতের বকেয়া পরিশোধ করা হবে। ভর্তুকি-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে বিল দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে ভর্তুকির পুরোটাই পরিশোধ করা হলেও বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের বেশ খানিকটা নিচে থাকবে বলেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক হিসেবে উঠে এসেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি রোধে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে সরকারি ব্যয়েও সাশ্রয়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া অনেক প্রকল্প বাতিল বা স্থগিত করা
হয়েছে। সরকারি ব্যয়েও সাশ্রয়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ক্ষমতার পালাবদলে সৃষ্ট আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পাশাপাশি প্রশাসনে রদবদলের ধাক্কায় উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ধীরগতি রয়েছে। উন্নয়ন বাজেটে সরকারের নিজস্ব বেঁচে যাওয়া অর্থের প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ পরিশোধ করবে সরকার।
জানা গেছে, গত দুই অর্থবছরের বরাদ্দের চেয়ে বেশি চাহিদা থাকায় সার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বাবদ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার বকেয়া রয়ে গেছে। একই সঙ্গে চলতি অর্থবছরে এ খাতে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকির পরিশোধ করতে হবে। চলতি অর্থবছরই যতদূর সম্ভব ভর্তুকি বাবদ পাওনার পুরোটাই পরিশোধ করতে চায় সরকার। এ জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি), পেট্রোবাংলা, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সঙ্গে বৈঠক করে সব তথ্য নেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ভর্তুকি বাবদ ৭৫ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হতে পারে।