

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পটুয়াখালীর চারটি আসনই এখন বহুমাত্রিক রাজনৈতিক সমীকরণে উত্তপ্ত। মাঠে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি বিরোধী দলগুলোর জন্য এক নতুন রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি করেছে। দলীয় শক্তি, ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা, মাঠ-সংগঠনের প্রভাব এবং ভোটবাক্সের মনস্তত্ত্বÑ সবকিছু মিলিয়ে গড়ে উঠেছে জটিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। একই জেলায় চারটি আসনে চার ধরনের বাস্তবতা। কোনোটিতে বিএনপির ভূমিধস জয়ের সম্ভাবনা, কোনো আসনে জামায়াতের উত্থান, ব্যক্তি রাজনীতির জোয়ার, আবার কোথাও ভোটের মাঠ রূপ নিয়েছে তিন বা চারজনের লড়াইয়ে। এই বৈচিত্র্যই পটুয়াখালীকে এ নির্বাচনের অন্যতম আলোচিত জেলায় পরিণত করেছে।
পটুয়াখালী-১ (সদর-মির্জাগঞ্জ-দুমকী) : পটুয়াখালী সদরের আসনটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে একে অপরের প্রবল প্রতিপক্ষ। ১৯৯৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন থেকে শুরু করে সব কটি নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক মন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) আলতাফ হোসেন চৌধুরী। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনিই ধানের শীষের প্রার্থী। ধানের শীষের প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচার জোরেশোরে চলছে। তিনটি ইউনিয়ন বাদে বাকি সব ইউনিয়নে হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে জনসভা সম্পন্ন করা হয়েছে।
এ আসনে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হচ্ছে জেলা জামায়াতের আমির অ্যাডভোকেট নাজমুল আহসানকে। এ আসনে আরও প্রার্থী হবেন গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদ সদস্য কৃষিবিদ মো. শহিদুল ইসলাম ফাহিম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুফতি আলহাজ হাবিবুর রহমান ও এনসিপির মো. জহিরুল ইসলাম মুসা।
পটুয়াখালী-২ (বাউফল) : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা আগে থেকেই বেশ সরব। বিএনপির ত্রিমুখী প্রচারে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ৪ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সাবেক সংসদ সদস্য শহীদুল আলম তালুকদারের নাম ঘোষণা করা হয়। উপজেলা বিএনপির একাধিক নেতা জানান, বাউফলে মনোনয়ন দৌড়ে তিনজন প্রার্থী আলোচনায় ছিলেন। কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক মো. মুনির হোসেন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ফারুক আহমেদ তালুকদার এবং সাবেক সংসদ সদস্য শহীদুল আলম তালুকদার। তিন প্রার্থী ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামলে ধানের শীষের জয় খুব সহজেই নিশ্চিত করা সম্ভব।
স্বাধীনতার পর থেকে আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে থাকলেও ২০০১ সালে শহিদুল আলম তালুকদার বিএনপির প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ থাকায় মাঠে একক আধিপত্য নিয়ে কাজ করছে বিএনপি। বিএনপির মধ্যে কোন্দল থাকায় সেখানে সুবিধা নিচ্ছে জামায়াত। এলাকার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, যদি ইসলামিক দলগুলো ঐক্য গড়ে তাহলে বিএনপির কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে জামায়াত ইসলামীর প্রার্থীর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তা না হলে এ আসনটি বিএনপিরই থাকবে বলে মনে করেন তারা।
বাউফলে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। বাউফলের একাধিক ব্যক্তি জানান, গত বছর ৫ আগস্টের পরে ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বাউফলে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত বাউফল উন্নয়ন ফোরামের মাধ্যমে অসহায় মানুষ হাজার হাজার টাকা সহায়তা দিয়েছেন। দলগতভাবে বাউফলে জামায়াতের বড় ভোট ব্যাংক না থাকলেও ব্যক্তি ইমেজের কারণে বিএনপির সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। বিএনপি ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে এ আসন বিএনপির হাতছাড়া হতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা আবদুল মালেক আনোয়ারী প্রার্থী হচ্ছেন বলে জানা গেছে।
পটুয়াখালী-৩ (দশমিনা-গলাচিপা) : জেলার দশমিনা ও গলাচিপা উপজেলা নিয়ে গঠিত পটুয়াখালী-৩ আসনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। এ আসনে এখনও বিএনপির মনোনয়ন ঘোষণা করা হয়নি। শরিক দলের জন্য আসনটি শূন্য রাখা হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
স্থানীয়রা জানান, শুধু বর্তমান প্রেক্ষাপটই নয়, ডাকসুর সাবেক ভিপি ও গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর জোট না হলেও এ আসন থেকে এককভাবে নির্বাচন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি আসনটিতে গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন। একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক জানান, ভিপি নূর যেভাবে এ আসনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন তাতে বিএনপি এবং গণঅধিকার পরিষদ আলাদা নির্বাচন করলে ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। কোনো কারণে যদি বিএনপি আসনটি গণঅধিকার পরিষদকে ছাড় দেয় তাহলে নূরের জয়লাভ খুবই সহজ হবে বলে মনে করেন তারা। এ আসনে জমায়াতে ইসলামী থেকে অধ্যাপক শাহ আলম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে মুফতি আবু বক্কর সিদ্দিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-কুয়াকাটা-রাঙ্গাবালী) : এ আসনে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তৎপরতা। বিএনপির ‘ধানের শীষ’ ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ‘হাতপাখা’ প্রতীকের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখা
দিয়েছে। তবে এ আসনে জামায়াতে ইসলামীও তাদের ‘দাড়ি-পাল্লা’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে। এ ছাড়া গণঅধিকার পরিষদ, এনসিপি এবং বাংলাদেশ আমজনগণ পার্টি নিজেদের মতো করে এ আসনে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন।
সরেজমিন সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এবিএম মোশাররফ হোসেনকে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। তবে সদ্য বিএনপি থেকে ইসলামী আন্দোলনে যোগদানকারী সাবেক এমপি, দুবারের উপজেলা চেয়ারম্যান ডা. মুস্তাফিজুর রহমান এ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন। মুস্তাফিজুর রহমান নিয়মিত ইউনিয়ন, ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারে অংশ নিচ্ছেন।
এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা মোহাম্মদ কাইয়ুম।

