

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের দীর্ঘ বিলম্ব এখন ব্যয়, ঋণের চাপ ও বিদ্যুৎ নিরাপত্তা—সর্বক্ষেত্রেই নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী এ বছরের ডিসেম্বরে প্রথম ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর কথা থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। একইভাবে দ্বিতীয় ইউনিটের সূচিও পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে প্রকল্পের ব্যয় আরো ২৬ হাজার ১৮১ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এতে মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে এক লাখ ৩৯ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা মূল অনুমোদিত ব্যয়ের তুলনায় প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে প্রকল্পের মেয়াদও ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, অর্থাৎ আরো তিন বছর বৃদ্ধি।
ব্যয় ও মেয়াদ দুই দিকেই বড় পরিবর্তন : নভেম্বরের শুরুর দিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় প্রথম সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবে ব্যয় ১১.৮৪ শতাংশ বা ১৩ হাজার ৩৮৬.২১ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। তবে পিইসি সভায় (১১ নভেম্বর) জানানো হয়, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি, ফলে মোট ব্যয়ের হিসাবও সঠিক হয়নি।
পরে হিসাব পুনর্মূল্যায়ন করে ২৭ নভেম্বর নতুন ব্যয় প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়।
২০১৬ সালে অনুমোদিত মূল প্রকল্পে ব্যয় ধরা ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৯২.৯১ কোটি টাকা। প্রকল্পের ব্যয় বাড়লেও রাশিয়ার ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ডলারের অঙ্কে অপরিবর্তিত; তবে টাকার অঙ্কে তা এখন এক লাখ ১৬ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা, যা মূল প্রস্তাবের (৯১ হাজার ৪০ কোটি) তুলনায় অনেক বেশি।
ডিপিএ (ডেভেলপমেন্ট পার্টনারস অ্যাসিস্ট্যান্স) ব্যবহার হিসেবেও নতুন বিনিময় হার যুক্ত হয়েছে—২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ৮.২৯ বিলিয়ন ডলারের হিসাবে এক ডলার ৯৫.২৮ টাকা, আর বাকি তিন বছরের ৩.০৯ বিলিয়ন ডলারের হিসাবে এক ডলার ১২২ টাকা (বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৬ নভেম্বরের হার) ধরা হয়েছে।
চুক্তি, নির্মাণ ও নতুন চ্যালেঞ্জ : বাংলাদেশ-রাশিয়ার আন্ত সরকার চুক্তি (আইজিএ) অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশন (বিএইসি) ২০১৫ সালে রাশিয়ার অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্টের সঙ্গে চুক্তি করে। প্রকল্পে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট নির্মাণ, যন্ত্রপাতি সরবরাহ, প্রশিক্ষণ ও জ্বালানি সরবরাহ অন্তর্ভুক্ত।
প্রথম সংশোধিত প্রস্তাব অনুযায়ী প্রথম ইউনিট ২০২৬ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল। নতুন সময়সূচির কারণে দ্বিতীয় ইউনিটও প্রভাবিত হবে।
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, ব্যয়ের সঠিক হিসাব না হলে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ, আর্থিক বিশ্লেষণ ও আয়-ব্যয় নির্ধারণে ভুল হতে পারে। পিইসি সভায় আয়-ব্যয়, অর্থনৈতিক অনুমান, পূর্তকাজ, রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়সহ বিভিন্ন ইকোনমিক কোড নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
ঋণ বিতরণে বিলম্ব ও পরিশোধ ঝুঁকি : রূপপুর প্রকল্পের মোট ব্যয় ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলার, এর ৯০ শতাংশ দিচ্ছে রাশিয়া। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ পেয়েছে ৭.৭০ বিলিয়ন ডলার। কভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ঋণ বিতরণে বিলম্ব হয়েছে। খসড়া প্রটোকলে স্বাক্ষর হলে বাকি ৩.৬৮ বিলিয়ন ডলার ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পাওয়া যাবে।
ঋণের পরিশোধ ২০২৯ সালের মার্চ থেকে শুরু হবে। ২০ বছরে দুই কিস্তিতে তা পরিশোধ করতে হবে। কোনো কিস্তি ৩০ দিনের বেশি দেরি হলে বার্ষিক ১৫০ শতাংশ সুদ ধার্য হবে।
উৎপাদনসূচি নিশ্চিত নয় : ডিসেম্বরে ইউনিট-১ থেকে উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়েছে। ইউনিট-২ ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে যেতে পারবে কি না, তাও নিশ্চিত নয়।
আইএমইডির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউনিট-১ ও ২-এর নতুন উৎপাদন সূচি এখনো নিশ্চিত নয়; প্রকল্প দপ্তর অসমাপ্ত কাজের তালিকা দিতে পারেনি; অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্টের সঙ্গে সমন্বয় জোরদার করে সময় নির্ধারিত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইএইএ বলছে, ফুয়েল লোডিংয়ের মাধ্যমে কমিশনিং শুরু হয়—এর মধ্যে থাকে প্রথম ক্রিটিক্যালিটি, পাওয়ার অ্যাসেনশন ও পূর্ণক্ষমতা পরীক্ষা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ডিসেম্বরে ফুয়েল লোডিং শুরু হবে এবং আগামী মার্চে আংশিক উৎপাদন শুরু হতে পারে। পূর্ণ এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদনে সময় লাগবে প্রায় ১০ মাস।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, টাকার অবমূল্যায়নসহ বিভিন্ন কারণে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের তুলনায় ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। প্রকল্প এরই মধ্যে প্রায় তিন বছর পিছিয়েছে, ফলে ঋণের কিস্তি বেশি দিতে হচ্ছে; স্থাপিত যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল কমছে এবং প্রকল্প জনবলের বেতন-ভাতা বাড়ছে।
তিনি বলেন, সময়মতো প্রকল্প চালু হলে জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানির চাপ কমত। তাঁর মন্তব্য, সব মিলিয়ে রূপপুর প্রকল্পের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাঝুঁকি বাড়ছে।

