বড় রাজস্ব ঘাটতি, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিতে ভাটা, ক্ষমতার পালাবদলের পর ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাসহ নানা কারণে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারের ব্যাংকঋণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, এ সময়কালে সরকারের নিট ব্যাংকঋণের পরিমাণ ২০ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ঋণাত্মক ৭৪১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। হিসাব অনুযায়ী এক বছরের ব্যবধানে সরকারের ঋণ বেড়েছে ২৯১৬.৭৩ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ১০ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। আর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এ সময়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা। গত জুলাই-ডিসেম্বরে রাজস্ব আদায় হয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। আর লক্ষ্য ছিল দুই লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা।
তবে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের জন্য ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে প্রায় ৭৪ হাজার ৪২০ কোটি টাকা।
একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পরিশোধ করা হয়েছে ৫৮ হাজার ৬৬১ কোটি টাকার বেশি।
অর্থবছরের শুরুতে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল চার লাখ ৭৪ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই ঋণের পরিমাণ হয় চার লাখ ৯৫ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে সাত মাস ১০ দিনে ব্যাংক খাত থেকে ২০ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ৮৪ হাজার ৮২ কোটি টাকা নিয়েছিল সরকার। অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এর সমালোচনা করে বলেছিলেন, এটি মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ঋণ সুবিধা বন্ধ করে দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ দেওয়া বন্ধ করায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়া ছাড়া সরকারের কোনো উপায় ছিল না। তাঁর মতে, উচ্চ সুদহার ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.২৮ শতাংশ। এটি বেসরকারি খাতে ইতিহাসের সর্বনিম্ন ঋণ প্রবৃদ্ধি। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে আগ্রহী না হওয়ায় ব্যাংকগুলোর হাতে টাকা পড়ে আছে। তাই ব্যাংকগুলো সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। বিদেশ থেকেও টাকা কম আসছে। তাই সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণের অন্য একটি উপায় হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ছাপানো। কিন্তু সেটা অধিক হারে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। বেসরকারি খাতের ঋণ কমিয়ে সরকারি খাতে দিলে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাবটা কম। সম্প্রতি মুদ্রানীতি ঘোষণা করে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি থেকে ৯৯ হাজার কোটিতে নামানো হয়েছে। এটা আরো কমানো দরকার। তবে এটা বাস্তবায়ন করতে পারলেও ভালো।
তিনি আরো বলেন, ‘এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের রাজস্ব আহরণ বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু বাড়াবেন কিভাবে? ভ্যাট ট্যাক্স বাড়ালে সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর প্রভাব পড়বে। তাই নতুন কোনো কৌশল বের করতে পারলে ভালো হয়, যার মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ বাড়বে কিন্তু সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।’ কর দিতে যারা ফাঁকিবাজির পথ অবলম্বন করে তাদের করের আওতায় আনতে পারলে সবচেয়ে বেশি লাভ হবে বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী বলেন, ‘বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য প্রতিবছরই ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয় সরকার। তবে মূল্যস্ফীতির সময় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যেতে পারে। কারণ ব্যাংক থকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, বড় রাজস্ব ঘাটতির কারণে ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ নিতে হচ্ছে। তাই রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া দক্ষতার সঙ্গে হ্যান্ডল করা গেলে রাজস্ব আরো বাড়বে। কারণ আমাদের দেশের অনেক ক্ষমতাবান ব্যবসায়ী ট্যাক্স দেয় না। তাদের ট্যাক্সের আওতায় আনতে পারলে সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে না।’