মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের নানামুখী সংকটের মাঝেও মানুষের স্বপ্ন থেমে থাকেনি। শিল্প, সাহিত্য, সংগীতের মতো সিনেমাও ছিল সেই স্বপ্ন বুনে তোলার একটি শক্তিশালী মাধ্যম। নির্মাতারা বুঝেছিলেন, একটি নতুন রাষ্ট্রের আত্মপরিচয় গড়ে তোলায় সিনেমা শুধু বিনোদন নয়, এটি ইতিহাসের সাক্ষী, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার ভাষা।
ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে তারা ঠিক করলেন, এই নতুন দেশের গল্প, এই দেশের মানুষের হাসি-কান্না, ভালোবাসা পর্দায় তুলে ধরা হবে। নিজের সাধ্যমতো, সীমিত যন্ত্রপাতি, ছোট বাজেট, নড়বড়ে স্টুডিও- সবকিছু নিয়েই তারা কাজ শুরু করেন। একে একে নির্মিত হয় অনেক সিনেমা। ধারাবাহিকভাবে তা মুক্তিও পায়। কিন্তু স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশে প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা নিয়েও অনেকের মধ্যেই রয়ে গেছে প্রশ্ন।
‘প্রথম’ শব্দটি দুটি সিনেমার আগেই লেখা যাবে নির্দ্বিধায়। কারণ, দুটি সিনেমা রয়েছে দুই বিভাগের প্রথম স্থানে। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমা ‘মানুষের মন’।
এটি মুক্তি পায় ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। অন্যটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা ‘ওরা ১১ জন’। এটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭২ সালের ১১ আগস্ট। এটিই স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম যুদ্ধভিত্তিক সিনেমা। আর দুই সিনেমায়ই অভিনয় করেছেন নায়করাজ রাজ্জাক। তার সঙ্গে সহশিল্পী ছিলেন ববিতা ও শাবানা।
মানুষের মন
এটি স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমা। এর গল্প পারিবারিক ও ব্যক্তি মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে। এটি মুক্তির পর এর ব্যবসায়িক সাফল্যে বাংলাদেশের সিনেমা নতুনভাবে জেগে ওঠে। আর এ জাগরণের কাণ্ডারি নির্মাতা মোস্তফা মেহমুদ। ‘মানুষ অন্যের মনের খবর নিতে যায় ঠিকই কিন্তু নিজের মনের হদিস সে পায় না’- এমনই একটি বাণী দিয়ে শুরু হয় ‘মানুষের মন’ সিনেমাটি। এর কাহিনি ও সংলাপ রচনা করেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন মোস্তফা মেহমুদ। এতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক, ববিতা, রোজী আফসারী, আনোয়ার হোসেন, আনোয়ারা, আনিস, খান জয়নুল, ইনাম আহমেদ।
ওরা ১১ জন
সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে তখন সমস্যার অন্ত নেই। পাকিস্তানিদের সঙ্গে নয় মাস লড়াইয়ের দগদগে ক্ষত দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে। যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে তখনো মুক্তির অপেক্ষায় থাকা জনগণের অনেকের পেটেই ভাত নেই। এ রকম সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সিনেমা বানানো সহজ ছিল না।
তবুও সাহস দেখিয়েছিলেন নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম। বিজয় অর্জনের এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি নেমে পড়েন ‘ওরা ১১ জন’ নির্মাণের কাজে। এতে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, খসরু, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলতাফ, এটিএম শামসুজ্জামান, মুরাদ, সিদ্দিক জামাল নান্টু, বেবী জামান, আবু, খলিলউল্লাহ খান প্রমুখ। এ সিনেমায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক নৃশংস গণহত্যার করুণ ইতিহাস উঠে আসে।
এর মধ্যেই বাঙালির আত্মত্যাগ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত না করা, গেরিলা যোদ্ধাদের বীরত্ব ফুটিয়ে তুলেছিলেন নির্মাতা। এতে যুদ্ধে নারীর অবদানকেও সরাসরি তুলে আনা হয়েছিল। কেবল বীরাঙ্গনা হিসাবে নারীর আত্মত্যাগই নয়, যুদ্ধের ময়দানে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীদের লড়াইয়ের চিত্রও উঠে এসেছে।
‘আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপিত হয়েছিল ১১ দফা ছাত্র আন্দোলন থেকে, যা পরবর্তীকালে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। তা ছাড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ১১ জন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। এ চিন্তা থেকে সবার সম্মতিক্রমে সিনেমার নাম নির্বাচিত হল ওরা ১১ জন’- এক সাক্ষাৎকারে সিনেমাটির নামকরণ সম্পর্কে এমনটাই জানিয়েছিলেন নির্মাতা।
সিনেমার অন্যতম চরিত্র, মুক্তিযোদ্ধা খসরুর বোন, মেডিকেল ছাত্রী মিতার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শাবানা। যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই প্রত্যন্ত গ্রামে চলে যায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতে। সেখানেই পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিগৃহীত হতে হয় তাকে। ধর্ষণের গ্লানি বয়েও শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাতেই নিয়োজিত থাকে সে।
এদিকে দীর্ঘদিন পাকিস্তানিদের অত্যাচার সহ্য করা পারভেজ ফিরে এসে যখন জানতে পারে, তার প্রেমিকা মিতার সম্ভ্রমহানীর কথা, তখন ঘৃণায় দূরে ঠেলে দেওয়ার পরিবর্তে ভালোবাসা দিয়ে প্রেয়সীকে বুকে টেনে নেয় সে। সেই পারভেজের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক।