ঢাকা
২১শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
সন্ধ্যা ৬:৫৮
logo
প্রকাশিত : জুন ২১, ২০২৫

করোনার চিকিৎসা সরঞ্জামে পুকুর চুরি

দেশে ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় পরিস্থিতি মোকাবেলা ও পরবর্তী সময়ের প্রস্তুতির জন্য তৎকালীন সরকার বিপুল অঙ্কের প্রকল্প হাতে নেয়। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হলেও বাস্তবে দুর্নীতির কারণে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পর্যবেক্ষণে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ওই প্রকল্প সফল না হওয়ায় প্রস্তুতিতে বেশ ঘাটতি রয়েছে।

এতে সাম্প্রতিক করোনা ব্যাপকভাবে ছড়ালে তা মোকাবেলা করা সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সূত্র মতে, কভিড মহামারির সময় পরিস্থিতি মোকাবেলায় তৎকালীন সরকার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) মাধ্যমে ছয় হাজার ৩৮৭ কোটি টাকার ‘কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যান্ডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্প অনুমোদন করে। মূল লক্ষ্য ছিল, দেশে করোনা মোকাবেলার পাশাপাশি ভবিষ্যতের যেকোনো মহামারির জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামোগত সক্ষমতা গড়ে তোলা।

প্রকল্পের অন্যতম প্রধান কাজ ছিল ৫০টি জেলা হাসপাতালে ১০ শয্যার করে মোট ৫০০ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) স্থাপন।

বাস্তবে প্রায় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও তা চালু হয়েছে মাত্র ১৩টি জেলায়। অন্যগুলোর ক্ষেত্রে কোথাও কাগজেই সীমাবদ্ধ, কোথাও দরপত্রপ্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে, এর পরও বেশির ভাগ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।
সরকারি পর্যবেক্ষণ বলছে, প্রকল্পের মোট আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৬ শতাংশ, অথচ মূল কাঠামোগত উন্নয়নকাজে অর্থ ব্যয় হয়েছে মাত্র ৪১ শতাংশ।

এদিকে প্রস্তুতি না থাকায় করোনার নতুন ধাক্কা সরকারকে ফের চাপে ফেলবে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন সামান্য : ৫০টি জেলায় ১০ শয্যার করে ৫০০ আইসিইউ স্থাপনের লক্ষ্য ছিল। চালু হয়েছে মাত্র ১৩টি জেলায়।

১৬টি শিশু-আইসিইউ (পেডিয়াট্রিক) এবং ১৫টি মাতৃ-আইসিইউর (অবস্টেট্রিক)—কোনো কাজই শুরু হয়নি। ৫০টি জেলায় ২০ শয্যার এক হাজার আইসোলেশন ইউনিট নির্মাণের অগ্রগতি শূন্য।

এমনকি যেসব জেলায় আইসিইউ আংশিক চালু হয়েছে, সেগুলোতেও রয়েছে মানবসম্পদ সংকট, যন্ত্রপাতির ঘাটতি এবং পরিকাঠামোগত অসংগতি। কুমিল্লা, যশোর, টাঙ্গাইল, বরিশালসহ কয়েকটি জেলায় আইসিইউ ইউনিট চালু হলেও সেখানে নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্স, যন্ত্রপাতি ও রক্ষণাবেক্ষণব্যবস্থা।

আইসিইউর চাহিদা সবখানে, সংখ্যা অপ্রতুল : ঢাকার বাইরে সাধারণ মানুষ চিকিৎসার ক্ষেত্রে সব সময় পিছিয়ে থাকে। করোনা মহামারিতে তা আরো প্রকট হয়ে ওঠে। একজন রোগীর জন্য অক্সিজেন বা আইসিইউর প্রয়োজন হলেও তাকে পাঠাতে হতো ঢাকায় বা বিভাগীয় শহরে। এই দুর্ভোগ দূর করতেই জেলা পর্যায়ে আইসিইউ স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এ লক্ষ্যই সবচেয়ে উপেক্ষিত।

যশোর জেনারেল হাসপাতালে আইসিইউ বসানো হয়েছে চতুর্থ তলায়। কিন্তু লিফট ঠিকমতো কাজ না করায় সেখানকার রোগীরা ইউনিটে যেতে পারছে না। টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ ২০২১ সালে চালু হলেও জনবলসংকটে ২০২৪ সালে তা বন্ধ হয়ে গেছে।

আইসিইউর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন বা ভবন নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল গণপূর্ত অধিদপ্তরের (পিডব্লিউডি)। কিন্তু আইএমইডির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, পিডব্লিউডি সময়মতো কাজ শুরুই করতে পারেনি। অনেক জায়গায় এখনো সিভিল ওয়ার্ক হয়নি। ফলে যন্ত্রপাতি এলেও বসানো যায়নি।

জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জরুরি ভিত্তিতে অন্তত ৫০০ জন নার্স, ২০০ জন চিকিৎসক ও সমসংখ্যক টেকনিশিয়ান নিয়োগের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু পাঁচ বছরে তা হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, আইসিইউ চালাতে যেসব দক্ষ জনবল দরকার, তাদের নিয়োগের বিষয়টি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক বলেন, এ ধরনের জরুরি প্রকল্পে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ মানবসম্পদ প্রস্তুত করা। প্রকল্পের পুরো সময়ে সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি, বরং সরঞ্জাম কেনাকাটার দিকেই ঝুঁকেছে। তিনি বলেন, সেবা প্রদানকারীর অভাব থাকলে সেই যন্ত্র মূল্যহীন।

নিয়ম না মেনে কেনাকাটা করায় সংকট : প্রকল্পের বিষয়ে আইএমইডির খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব সরঞ্জাম কেনা হয়েছে, এর মধ্যে অনেক আছে, যা সঠিক মডেল নয়, নেই প্রমাণিত কার্যকারিতা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরবরাহকারীরা ছিল অযোগ্য। ফলে চাহিদামতো সরঞ্জাম এলেও তা ব্যবহারযোগ্য নয়।

ফরেন এইডেড প্রজেক্টস অডিট ডিরেক্টরেট (ফাপাড) মোট ৪৬৫ কোটি টাকার অনিয়ম চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে অনেক সরঞ্জামের মান যাচাই না করেই গ্রহণ করা হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে এলসি খোলা এবং পণ্য সরবরাহে দীর্ঘ বিলম্ব হয়েছে।

ঘন ঘন নেতৃত্ব পরিবর্তন, ধারাবাহিকতার অভাব : প্রকল্প পরিচালনায় শুরু থেকেই ছিল প্রশাসনিক অস্থিরতা। পাঁচ বছরে সাতজন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) বদল হয়েছে, যাঁদের মধ্যে মাত্র দুজন ছিলেন পূর্ণকালীন। অন্যরা ছিলেন অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত, অনেকে দুই থেকে চার মাসের বেশি থাকেননি।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রকল্পের নেতৃত্বে স্থায়িত্ব ও জবাবদিহি না থাকায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কার্যত থমকে পড়ে। এর প্রমাণ মেলে বাস্তবায়ন পর্যায়ে, যেখানে বেশির ভাগ কাজ থেমে আছে নকশা বা দরপত্র স্তরে।

প্রকল্প কর্মকর্তাদের স্থবিরতা ও আতঙ্ক : আইএমইডির তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে করা এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফাপাডের অডিট আপত্তির পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কার্যক্রম চালাতে ভয় পেতে থাকেন। মিডিয়ার চাপ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানের কারণে অনেক কর্মকর্তা কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।

একজন সাবেক প্রকল্প পরিচালক বলেন, অভিযোগ সামলাতে সামলাতেই সময় চলে গেছে। বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ দেওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, এই প্রকল্প ছিল এক দুর্যোগে জরুরি প্রস্তুতি। অথচ দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক স্থবিরতা সেটিকে পুরোপুরি ভেস্তে দিয়েছে। অর্থ শুধু অপচয় হয়নি, নাগরিক স্বাস্থ্যসেবার প্রতি রাষ্ট্রের দায়হীনতা সামনে এসেছে।

সরকারি পর্যবেক্ষণ বলছে, রাজস্ব খাতে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি কেনাকাটা হলেও অবকাঠামো খাতের বরাদ্দের ৫৯ শতাংশই খরচ হয়নি। অন্যদিকে দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও অস্বচ্ছ কেনাকাটার কারণে প্রকল্পটির বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়েছে ৭৬টি অডিট আপত্তি, যার পরিমাণ প্রায় ৪৬৫ কোটি টাকা। এই অনিয়মের মধ্যে রয়েছে অনভিজ্ঞ ঠিকাদার নিয়োগ, ট্যাক্স-ভ্যাট না কাটা, নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ ও সরাসরি ক্রয়ের অপব্যবহার।

মেয়াদ শেষের দিকে, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ : প্রকল্পের সময়সীমা দুই দফা বাড়িয়ে চলতি জুন ২০২৫ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। বাস্তবতা হলো, বরাদ্দের বড় অংশই এখনো অব্যয়িত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে লক্ষ্য ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে এটি শুরু হয়েছিল, বাস্তবায়নে তার সামান্য অংশও পূরণ হয়নি। বরং প্রকল্পটি একটি ব্যর্থ উদাহরণ হিসেবেই চিহ্নিত হচ্ছে এখন।

এ বিষয়ে প্রকল্পটির বর্তমান পরিচালক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পটি চলতি জুনে শেষ হয়ে যাবে। যেসব কাজ বাকি আছে, সেগুলো স্বাস্থ্যের অপারেশন প্ল্যানের (ওপি) মাধ্যমে করা হবে। সেই প্রকল্পের আওতায় বাকি সব আইসিইউ নির্মাণ করা হবে।

করোনার নতুন ঢেউ চাপ হতে পারে : স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, করোনার নতুন ঢেউ মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকায় সরকার ফের বিপাকে পড়তে পারে। আইসিইউ, আইসোলেশন ইউনিট ও মানবসম্পদ ঘাটতি এখনো কাটেনি। এখনই জরুরি প্রস্তুতি না নিলে সংক্রমণ বাড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram