রাজশাহী থেকে মোঃ হায়দার আলী: কোরবানির ঈদে পশু জবাইয়ের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো চামড়া সংরক্ষণ। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক সময় এই চামড়া শিল্প ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিমুখী খাত। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে এ খাত নানা সংকটে পড়েছে।
বিশেষ করে গ্রামীণ ও স্থানীয় পর্যায়ে মসজিদ, মাদ্রাসা, ইয়াতিমখানা এবং লিল্লাহ বোর্ডিংগুলো কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করে যা আয় করত, তা দিয়ে তাদের বার্ষিক অনেক খরচ নির্বাহ হতো। অথচ সময়ের সাথে এই আয়ের উৎসটি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
সঠিকভাবে চামড়া সংরক্ষণের অভাবে অনেক সময় তা পচে যায়, ফলে বাজারে বিক্রি করাও সম্ভব হয় না। এ কারণে সরকারের পক্ষ থেকে এবার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা রাজশাহী জেলায় কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
রাজশাহী জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ২০২৫ সালের ঈদ-উল-আযহাকে সামনে রেখে রাজশাহী জেলা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় চামড়া সংরক্ষণের জন্য ২৬৩.৩ মেট্রিক টন লবণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই লবণ বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে মসজিদ, মাদ্রাসা, ইয়াতিমখানা এবং লিল্লাহ বোর্ডিংসহ বিভিন্ন চামড়া সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানের মাঝে।
উপজেলা ভিত্তিক বরাদ্দঃ রাজশাহী জেলার মোট নয়টি উপজেলাসহ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় যে পরিমাণ লবণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তার বিবরণ নিম্নরূপ:গোদাগাড়ী উপজেলা: ৯ মেট্রিক টন বাঘা উপজেলা: ৫৮.৩ মেট্রিক টন চারঘাট উপজেলা: ৯ মেট্রিক টন
পুঠিয়া উপজেলা: ১৩.৫ মেট্রিক টন দুর্গাপুর উপজেলা: ১৩ মেট্রিক টন তানোর উপজেলা: ৬ মেট্রিক টন বাগমারা উপজেলা: ২০ মেট্রিক টন
পবা উপজেলা: ৬৪.৯ মেট্রিক টন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন: ৪২.৬ মেট্রিক টন
এই লবণ প্রায় ১৩৫ টি এতিমখানা, মাদ্রাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিং-এ সরাসরি বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে লবণের ঘাটতির মুখোমুখি হবে না বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রশাসনের তদারকি ও ব্যবস্থাপনাঃ রাজশাহী জেলা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মির্জা ইমাম উদ্দিন জানিয়েছেন, “শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী লবণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে উপজেলাভিত্তিক তালিকা তৈরি করে এসব প্রতিষ্ঠানকে ঈদের আগেই লবণ সরবরাহ শুরু করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা স্থানীয় পর্যায়ে এই কার্যক্রম তদারকি করছেন এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সার্বিক পর্যবেক্ষণে রয়েছেন।”
মাঠ পর্যায়ে ইতিবাচক সাড়াঃ গোদাগাড়ী উপজেলার নির্বাহী অফিসার ফয়সাল আহমেদ বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে ১৫ টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রণয়ন করে লবণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছি। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে চামড়া সংরক্ষণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। আশা করছি এবছর স্থানীয় পর্যায়ের চামড়া ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়বেন না, বরং লাভবান হবেন।”
জেলা প্রশাসকের দৃষ্টিভঙ্গিঃ রাজশাহী জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতার বলেন, “ঈদ-উল-আযহাকে কেন্দ্র করে চামড়া একটি বড় বিজনেসের অংশ। বিগত বছরগুলোতে মসজিদ-মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো এই খাতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা দেখেছি, লবণের অভাবে চামড়া নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে এই শিল্প একেবারে ধ্বংসের পথে। সরকার এবার অত্যন্ত সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “লবণ বরাদ্দ ও ক্রয়ের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে এবং বিতরণ কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কোন প্রতিষ্ঠান কতগুলো চামড়া সংগ্রহ করবে সে অনুযায়ীই লবণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যাতে কোন প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় লবণ না পায়।”
চামড়া জেলার বাইরে নেওয়ায় বিধিনিষেধঃ চামড়া শিল্পে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও বাজারে অস্থিরতা রোধে সরকার একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে- ঈদের পর প্রথম ১০ দিন চামড়া জেলার বাইরে নেওয়া যাবে না। দেশের ৬৪ জেলায় একই নীতিমালা বাস্তবায়িত হবে। এই সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্টরা চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত রাখবে, এরপর ধীরে ধীরে তা বাজারজাত করা হবে।
রাজশাহীর চামড়া ব্যবসায়ীরা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো মনে করছেন, এই উদ্যোগ তাদের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে। সরকারের এই সময়োপযোগী পদক্ষেপ স্থানীয় চামড়া শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করবে বলে তাদের বিশ্বাস।