বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে বরগুনার পাথরঘাটায় বেড়িবাঁধ ভেঙে ছয় গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। খুলনার কয়রায় একটি বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সাগরের ঝোড়ো হাওয়া ও ঢেউয়ের তোড়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উপকূলে তীরে আটকে গেছে চার জাহাজ।
কক্সবাজারের টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের ১০০ মিটার অংশ ভেঙে গেছে। নোয়াখালীর হাতিয়ায় মেঘনায় ডুবে গেছে মালবাহী একটি ট্রলার। টানা বর্ষণে পাহাড় ধসের কারণে বান্দরবান-রুমা সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এসব ঘটনা ঘটে।
উপকূলে আটকা চার জাহাজ
চট্টগ্রামে ঝোড়ো হাওয়া ও সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের কারণে চারটি জাহাজ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উপকূলে আটকে গেছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত এসব নৌযান চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উপকূলে আটকা পড়ে। চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমার আওতাধীন আনোয়ারা উপকূলে আটকে পড়েছে মারমেইড-৩ নামের একটি বার্জ এবং নাভিমার-৩ নামের একটি টাগবোট। জানা গেছে, বার্জটি প্রায় দুই বছর আগে বাঁশখালীর এস এস পাওয়ার প্ল্যান্টের নির্মাণকাজে ব্যবহারের জন্য ভারত থেকে পাথর পরিবহন করেছিল। নাভিমার-৩ টাগবোটটি এ বার্জটিকে টেনে আনতে সহায়তা করেছিল।
একই রাতে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা উপকূলে আরো দুটি নৌযান এমভি আল-হেরেম ও বিএলপিজি সুফিয়া আটকে পড়ে। বিএলপিজি সুফিয়া জাহাজটি গত বছরের অক্টোবরে কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে গ্যাস স্থানান্তরের সময় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নৌযানগুলো উদ্ধারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর সতর্ক করে বলেছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিন্মচাপের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় ঝোড়ো হাওয়া ও জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা রয়েছে।
মেরিন ড্রাইভ সড়কে ভাঙন
গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে দুই দিনের ভারী বৃষ্টি ও জোয়ারের পানির তীব্র ঢেউয়ের ধাক্কায় কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে ১০০ মিটার অংশ ভেঙে গেছে। সেখানে থাকা কয়েকটা ঝাউগাছও ভেঙে পড়েছে। দ্রুত ভাঙন ঠেকানো না গেলে সড়কটি সাগরে তলিয়ে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এ ব্যাপারে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহেসান উদ্দিন বলেন, মেরিন ড্রাইভ সড়কটি নির্মাণ, তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
পাহাড়ধসে বান্দরবান-রুমা সড়কে যোগাযোগ বন্ধ
নিম্নচাপের প্রভাবে বান্দরবানে টানা বর্ষণে বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে পড়েছে। পাহাড়ধসে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে বান্দরবান-রুমা উপজেলা সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চব্বিশ ঘণ্টায় ২২২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে জেলায়। এদিকে পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে সাঙ্গু ও মাতামুহুরি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলার সাতটি উপজেলার চৌত্রিশটি ইউনিয়নে ২২০টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
বাঁধ ভেঙে ছয় গ্রাম প্লাবিত
গতকাল শুক্রবার জোয়ারের তোড়ে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার নাছনাপাড়া ইউনিয়নের হলতা নদীর বেড়িবাঁধের মানিকখালী অংশ ভেঙে ছয় গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গ্রামগুলো হলো—মানিকখালী, নাচনাপাড়া, জ্ঞানপাড়া, উত্তর কাঠালতলী, কেরামতপুর ও পুটিমারা। এতে প্রায় ৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এছাড়া এসব এলাকার ২ শতাধিক মাছের ঘের প্লাবিত হয়ে প্রায় ২৫ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মিজানুর রহমান বলেন, বৃষ্টি থামলেই বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড ।
মেঘনায় ট্রলার ডুবি
নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় মেঘনা নদীতে ঝড়ের কবলে পড়ে এম বি ফাহিম নামে রড, সিমেন্ট, টিন ও মুদি মালামাল বোঝাই একটি ট্রলার ডুবে গেছে। বৃহস্পতিবার রাতে উপজেলার চানন্দী ইউনিয়নের শান্তিনগর ঘাটের নদী মোহনায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় ঐ ট্রলারের লোকজনকে স্থানীয় জেলেরা উদ্ধার করে। কেউ হতাহত না হলেও প্রায় ৪ কোটি টাকার মালামাল পানিতে তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা।
এদিকে উপজেলার নিঝুম দ্বীপসহ উপকূলীয় চরাঞ্চল শুক্রবার দুপুরে পুনরায় জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে কয়েক শ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ঝোড়ো বাতাস ও সাগর উত্তাল থাকায় তৃতীয় দিনের মতো হাতিয়ার সঙ্গে সারা দেশের নৌযোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এতে ২৪০ জনের অধিক পরীক্ষার্থীর জেলা শহর মাইজদীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শনিবারের অনার্স ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
খুলনায় বাঁধে ভাঙন
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে খুলনায় বিভিন্ন নদনদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে অন্তত চার ফুট বেশি উচ্চতার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। জোয়ারের পানির চাপে কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের হরিণখোলা নামক স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ১৩-১৪/ ২ নম্বর পোল্ডারের পাঁচটি স্থানে ৩০০ মিটার বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ মেরামত না করলে যে কোনো মুহূর্তে বাঁধ ভেঙ্গে এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে এলাকাবাসীর মধ্যে ভাঙন আতঙ্ক বিরাজ করছে। খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী (পাউবো) প্রকৌশলী শরিফুল আলম বলেন, বাঁধ ভাঙনের খবর জানার পর তাত্ক্ষণিকভাবে মেরামত কাজ শুরু করা হয়েছে।
চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের শঙ্কা
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে ভারী বৃষ্টিপাত ও ঝড়ো হাওয়ায় চট্টগ্রামের জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিগত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ২২৯ মিলিমিটার। নগরীর আশেপাশে ঝড়ো-হাওয়ায় বড় গাছপালা উপড়ে পড়তে দেখা যায়। এতে যানবাহন ও জনচলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। নগরীর চান্দগাঁও, বাকলিয়া, আগ্রাবাদ, চকবাজারসহ নিম্নঞ্চলগুলো অস্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার হয়। এই দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর পক্ষ থেকে পাহাড় ধসের আশঙ্কা ব্যক্ত করে জনগণকে সতর্কাবস্থায় থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস থেকে জানানো হয়, আজ শনিবারও ভারী বৃষ্টিপাত হবে। রবিবার থেকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসতে পারে।
বন্দর সূত্র জানায়, বৈরী আবহাওয়ায় সমুদ্র উত্তাল থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে পণ্য লাইটারিং। তবে বন্দরের জেটি, ইয়ার্ড, টার্মিনাল ও অফডকগুলোর আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সাগর উত্তাল থাকায় লাইটার জাহাজগুলো কর্ণফুলী নদীতে নোঙর করে আছে।
ভোলায় পানিবন্দি ৩ হাজার পরিবার
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে ভোলায় অস্বাভাবিকভাবে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ভোলার চরফ্যাশন, মনপুরা ও তজুমদ্দিন উপজেলায় পাঁচ সহস্রাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানির তোড়ে ভেসে গেছে সহস্রাধিক গবাদি পশু। চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলায় এখনো ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। এছাড়া ভোলার লালমোহন ও তজুমদ্দিন উপজেলার দুই স্থান দিয়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। অন্যদিকে জোয়ারের পানিতে ২৩৪টি ঘের ও ২ হাজার ৫৩৩টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় ৪৭৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।