গ্যাসসংকটের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই চাহিদামতো গ্যাস মিলছে না শিল্প-কারখানাগুলোতে। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় শিল্প-কারখানার পাশাপাশি সিএনজি স্টেশন, বিদ্যুৎকেন্দ্র, আবাসিক খাতসহ সব ক্ষেত্রে এখন গ্যাসের সংকট চলছে। শিল্পের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, গ্যাসসংকটের কারণে তাঁদের উৎপাদন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। গত কয়েক মাসে কয়েক শ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
রপ্তানি আয় কমেছে। বিনিয়োগ থমকে আছে। কর্মসংস্থান বাড়ছে না। শিল্প খাত না বাঁচলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি থেমে যাবে, তাই শিল্পের গ্যাস-বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে জোরালো উদ্যোগ নেওয়ার আহবান জানিয়েছেন তাঁরা।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। গতকাল শনিবার গ্যাস সরবরাহ করা হয় দুই হাজার ৬৯১ মিলিয়ন ঘনফুট। এতে গতকাল ঘাটতি ছিল এক হাজার ৩০৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। মোট দুই হাজার ৬৯১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে এক হাজার ৯০৯ মিলিয়ন ঘনফুট এবং আমদানি করা তরলীকৃত প্রকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে ৭৮১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়।
এদিকে রমজান ও গ্রীষ্মে বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা পূরণে বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাড়তি গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এতে আগামী দিনে শিল্পে গ্যাসসংকট আরো বাড়তে পারে বলে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
বাড়তি গ্যাস সরবরাহে কোনো সুখবর না থাকলেও এরই মধ্যে শিল্পের জন্য নতুন করে আরো ১৫২ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে গত বুধবার গণশুনানি করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বর্তমানে শিল্প-কারখানার গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৩০ টাকা এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে (শিল্পে ব্যবহৃত নিজস্ব বিদ্যুৎ) ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা দিতে হয়। নতুন শিল্পের জন্য এটি বাড়িয়ে ৭৫.৭২ টাকা করার প্রস্তাবের ওপর শুনানি গ্রহণ করা হয়েছে।
শুনানিতে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে পেট্রোবাংলা বলেছে, প্রতি ঘনমিটার এলএনজির বর্তমান আমদানিমূল্য পড়ছে ৬৫.৭০ টাকা। ভ্যাট-ট্যাক্স ও অন্যান্য চার্জ যোগ করলে দাঁড়ায় ৭৫.৭২ টাকা। ফলে এই খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে গ্যাসের দামের মধ্যে গ্যাপ কমাতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এলএনজি আমদানি করলে চলতি অর্থবছরে পেট্রোবাংলার ঘাটতি হবে প্রায় ১৬ হাজার ১৬১ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
শুনানিতে উপস্থিত থেকে শিল্পের উদ্যোক্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, শিল্পে নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অযৌক্তিক-অবাস্তব একটি সিদ্ধান্ত। এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকতে বিইআরসিকে আহবান জানান তাঁরা। শিল্প-কারখানার উদ্যোক্তারা আরো বলেন, এই অবস্থায় গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হলে বাংলাদেশে আর কোনো শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে না। টিকবে না শিল্প খাত। এর মাধ্যমে শিল্পের ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যাবে। শিল্পে নতুন বিনিয়োগ আসবে না, কর্মসংস্থানও হবে না। বিদেশি বিনিয়োগও আসবে না। বড় ধরনের প্রভাব পড়বে রপ্তানি শিল্পে, এতে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের শিল্প-কারখানা ধ্বংসের চক্রান্ত শুরু হয়েছে বলেও উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, বাজার অস্থিতিশীলতা, সুদহার বৃদ্ধি, ঋণপত্র খোলার অভাবে কাঁচামালের অপর্যাপ্ততা, শ্রমিক অসন্তোষ ও উৎপাদন অপ্রতুলতায় বিপুলসংখ্যক কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। যেগুলো টিকে আছে সেগুলোও অস্তিত্বের সংকটে ধুঁকছে। এ অবস্থায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি শিল্প খাতকে আরো ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও সাভার এলাকার শিল্প-কারখানাগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় এসব এলাকার শিল্প-কারখানা কখনো চলছে, কখনো বন্ধ থাকছে। গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিজস্ব ব্যবস্থা থাকলেও গ্যাসের সংকটে শিল্প-কারখানাগুলো সেগুলোও চালাতে পারছে না। এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়লেও সরবরাহ তেমন বাড়বে না। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ক্রমে কমছে। এটা শিগগিরই খুব বেশি বাড়ানোর সুযোগ নেই। এলএনজি থেকে সর্বোচ্চ আমদানির সক্ষমতা এক হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা না হলে আমদানি আর বাড়ানো যাবে না। আগামী দুই বছরেও নতুন টার্মিনাল চালুর তেমন সম্ভাবনা নেই। টার্মিনাল নির্মাণে কোনো চুক্তি করা হয়নি। আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া দুটি চুক্তি বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি এবং মুন্নু সিরামিকস ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস চেয়ারম্যান মইনুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে গ্যাসসংকটে শিল্প খাত অনেকটাই থমকে আছে। এই অবস্থায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির চিন্তা কিভাবে আসে আমরা বিষয়টি বুঝতে পারছি না। আমাদের সিরামিক খাতের প্রধান জ্বালানিই হলো গ্যাস, গ্যাসের স্বল্প চাপের কারণে সক্ষমতার অর্ধেকও উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় শিল্প খাত যাতে টিকতে না পারে সেই চিন্তা করেই গ্যাসের মূল্য আড়াই গুণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এটি দেশের স্বার্থের বিপক্ষের সিদ্ধান্ত হচ্ছে। যদি মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে এই খাতের ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যাবে। সরকারের ভুল নীতির কারণে এরই মধ্যে কাগজ ও চিনি শিল্প বন্ধ হয়ে আমদানিনির্ভর খাতে পরিণত হয়েছে।’
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় অনেক কম গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে, এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানো উচিত। এতে করে যে ঘাটতি রয়েছে সেটা পূরণ করা সম্ভব। গত ১৫ বছর আমরা দেশীয় গ্যাস আহরণ না করে আমদানির দিকে ঝুঁকেছি, যার ফলাফল আজকের এই পরিস্থিতি। আমরা কেন আমদানির দিকে গেলাম, কারণ হচ্ছে আমদানি করলে কমিশন বাণিজ্য করার সুযোগ থাকে। তাই তারা সেদিকে ঝুঁকেছিল।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে পোশাক শিল্প রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছি। তাই আমাদের নতুন নতুন কারখানা স্থাপন ও পুরনো কারখানাগুলো আরো সম্প্রসারণ করতে হবে। নতুন শিল্পের জন্য ৭৫ টাকা গ্যাস বিল দিয়ে কেউ এই খাতে বিনিয়োগ করবে না।’ তাই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি এখনই বন্ধ করে প্রয়োজনে কিভাবে গ্যাসের দাম কমানো যায়, সেদিকে বিইআরসিকে নজর দিতে অনুরোধ জানান তিনি।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) আয়োজিত সম্প্রতি ‘দেশের শিল্প খাতে জ্বালানিসংকট সমাধানের পথ’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, জ্বালানিসংকটে সিরামিক কারখানায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। পোশাক খাতে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ উৎপাদন কমেছে। স্টিল কারখানায় উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। গ্যাসের বিকল্প হিসেবে ডিজেল ব্যবহার এবং শ্রমিকদের বাড়তি কাজের জন্য খরচ বেড়ে গেছে। পল্লী বিদ্যুতের অধীন ক্ষুদ্র শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের ডিজেল জেনারেটর চালানো সম্ভব নয়। ফলে প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধের পথে। শিল্প খাতে গাসের চাহিদা ১০০ কোটি ঘনফুটের মতো। কিন্তু এখন দেওয়া হচ্ছে ৫০ কোটি ঘনফুট। গত দুই বছরে শিল্প খাতে জ্বালানির চাহিদা বাড়েনি।
বিসিআইয়ের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, ‘শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি দিন দিন কমছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এই খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.২৯ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে কমে হয় ৬.৬৬ শতাংশ। গত এপ্রিল থেকে জুন মাসে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৩.৯৮ শতাংশ। জ্বালানিসংকটের কারণে গত বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২০০টি শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, আরো ৩০০টি কারখানা ঝুঁকিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি সংকটে বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি আগস্ট, সেপ্টেম্বরে ৯.৮৫ শতাংশ কমেছে। বিদেশি বিনিয়োগ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ২০২২-২৩ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার কমেছে। বিপরীতে গ্যাসের দাম গত পাঁচ বছরে ২৮৬ শতাংশ বেড়েছে। যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ ৪১ শতাংশ কমেছে, কাঁচামালে কমেছে ৯.৮১ শতাংশ।
আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, ‘ম্যানুফ্যাকচারিং খাত ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি করা যাবে না। আগের সরকার গায়ের জোরে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল, তার পর থেকেই শিল্প খাতে ধস নামতে শুরু করে। গ্যাসের সরবরাহ না পেয়ে প্রতিটি ইন্ডাস্ট্রির উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। এরই মধ্যে আরএমজি সেক্টরের ২০০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর পরও গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা করা হলে ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হয়ে যাবে।’