ঢাকা
১০ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
রাত ৯:১০
logo
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৫

শিক্ষাখাতে বিশৃঙ্খলায় ‘দিশেহারা’ সরকার

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে শিক্ষাখাতে অস্থিরতা শুরু। সেই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন। ক্ষমতায় বসে অন্তর্বর্তী সরকার। ছয়মাস পার হলেও শিক্ষাখাতে স্থিতিশীলতা ফেরেনি। উল্টো বাড়ছে বিশৃঙ্খলা। কথায় কথায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। কেউ চান বিশ্ববিদ্যালয়, কেউ চাইছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন। যৌক্তিক-অযৌক্তিক বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে দখলে নিচ্ছেন রাজপথ।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনেকটা পাল্লা দিয়ে রাস্তায় নামছেন শিক্ষকরাও। কেউ আসছেন জাতীয়করণের দাবি নিয়ে, কেউবা বদলি বৈষম্যের প্রতিবাদে। কারও আবার বেতন বাড়ানোর আবদার। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিশৃঙ্খলার পথ থেকে ফেরাতে পারছে না অন্তর্বর্তী সরকার। গতিশীল করা যাচ্ছে না শিক্ষাপ্রশাসনও। মানহীন ডিগ্রিতে ভরা উচ্চশিক্ষায় হ-য-ব-র-ল অবস্থা। অস্থির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও।

শিক্ষাপ্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের রাজপথ থেকে সরিয়ে শ্রেণিকক্ষমুখী করতে ভালো কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকার। তাদের অযৌক্তিক দাবি নিয়ে করা আন্দোলন দমনেও ‘জুজুর ভয়’। পাশাপাশি শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও ত্রিমুখী রাজনৈতিক মেরুকরণ। উপদেষ্টা, বিশেষ সহকারী, সচিবের মধ্যেও ‘মনস্ত্বাত্তিক দ্বন্দ্ব’। একজন সামনে এগোলে আরেকজন পিছুটান দিচ্ছেন। কে, কোথায়, কার অনুসারীকে বসাবেন, তা নিয়েও বিভাজন। ফলে শিক্ষাখাতে শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না। আবার বড় ধরনের সংস্কারেও সরকারপ্রধানের আগ্রহ নেই।

‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করার ক্ষেত্রে আইন-সংবিধি করতে খুব বেশি সময় লাগে না। কারণ আগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংবিধি-আইনে যা আছে, সেভাবে নাম পাল্টে বসিয়ে দেওয়া হয়। সাত কলেজ নিয়ে গঠিত হতে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি তেমন হবে না। এ কারণে কাজটা কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং।’- ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ

সাত কলেজ নিয়ে মহাবিপাকে সরকার
রাজধানীর সরকারি সাতটি কলেজ আট বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত ছিল। দীর্ঘদিন ধরে কলেজগুলো ঢাবি থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি জানিয়ে আসছিল। তাদের অভিযোগ ছিল, যেসব সংকট নিরসনে কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন হয়নি। পূরণ হয়নি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও। উল্টো সংকট জটিল রূপ নিয়েছিল। দূরত্ব বেড়েছে ঢাবি ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও। অবশেষে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর গত ২৭ জানুয়ারি জরুরি বৈঠকে ঢাবির অধিভুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়।

অধিভুক্তি বাতিলে শিক্ষার্থীরা খুশি হলেও মহাবিপাকে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে কলেজগুলো এখন অভিভাবকহীন। এ অবস্থায় ভর্তি, পরীক্ষা ও শিক্ষা কার্যক্রম চালানো নিয়ে জটিলতা বেড়েছে। সরকার সাত কলেজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নিয়েছে। এখন প্রয়োজন আইন ও সংবিধি, যা করাটা সময়সাপেক্ষ। অথচ সরকারকে মোটেও সময় দিতে চান না শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামসহ কাঠামো ঠিক করে ঘোষণা দিতে হবে। সবমিলিয়ে জটিল সময় পার করছেন শিক্ষা উপদেষ্টা, শিক্ষাসচিব, ইউজিসিসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করার ক্ষেত্রে আইন-সংবিধি করতে খুব বেশি সময় লাগে না। কারণ আগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংবিধি-আইনে যা আছে, সেভাবে নাম পাল্টে বসিয়ে দেওয়া হয়। সাত কলেজ নিয়ে গঠিত হতে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি তেমন হবে না। এ কারণে কাজটা কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং।’

‘শিক্ষা উপদেষ্টা তিতুমীর শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তিতুমীরের এ দাবির যৌক্তিকতা দেখছে না সরকার। তাছাড়া একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দিতে কাজ করছে। সেই কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।’- শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের

ঢাকার সরকারি সাত কলেজের অন্যতম তিতুমীর কলেজ। ২৮ বছর ধরে ‘তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি জানিয়ে আসছেন কলেজটির শিক্ষার্থীরা। মাঝেমধ্যে আন্দোলন হয়, জনভোগান্তি বাড়ে; তারপর রফাদফা হয়ে যায়। এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। দল-নিরপেক্ষ সরকার ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরের এ সময়টাকে দাবি আদায়ের উপযুক্ত মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। সেজন্য অনশন, সড়ক-মহাসড়ক-রেলপথ অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি করছেন। ৩ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন স্থগিত করলেও সাতদিনের মধ্যে দাবি না মানলে ফের রাস্তায় নামার ঘোষণা দেন তারা।

সাত কলেজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় করতে হিমশিম শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেখানে তিতুমীরকে পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় দেওয়ার চিন্তাও করতে পারছে না সরকার। আর্থিক সক্ষমতা, অন্য পুরোনো কলেজগুলোর আপত্তিসহ নানান কারণে তিতুমীরের শিক্ষার্থীদের আবদারে সাড়া দিচ্ছে না মন্ত্রণালয়।

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের বলেন, ‘শিক্ষা উপদেষ্টা তিতুমীর শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে বক্তব্য দেন। তিতুমীরের এ দাবির যৌক্তিকতা দেখছে না সরকার। তাছাড়া একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দিতে কাজ করছে। সেই কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।’

‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জোর করতে পারি না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেই এখতিয়ার কিছুটা আছে। সেখান থেকে বারবার অনুরোধ করা হলেও কাজে আসছে না। সরকারকে এ নিয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। না হলে বড় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে।’- ইউজিসির সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান

২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়া চালু হয়। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষেও তিনটি গুচ্ছে ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নেয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এ বছর সাধারণ (জিএসটি) গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে গেছে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। ভেঙে গেছে প্রকৌশল গুচ্ছও। কৃষি গুচ্ছ এবার থাকলেও আগামী বছর সেখান থেকে অনেকে বেরিয়ে যেতে চায়।

গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেরিয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ। তারা বলছেন, গুচ্ছ ভর্তি থাকলে শিক্ষার্থীদের আবেদন ফি কমে যায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোটাছুটিও কম করতে হয়। ভোগান্তি কম থাকে। গুচ্ছ ভেঙে যাওয়ায় তাদের ভর্তি পরীক্ষা দিতে খরচ ও ভোগান্তি বেড়ে গেছে। এ নিয়ে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। তারা ইউজিসি ঘেরাওসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করছেন।

তবে গুচ্ছ পদ্ধতি বহাল রাখতে ব্যর্থ শিক্ষা মন্ত্রণালয়। উপাচার্যদের তিন দফা চিঠি দিয়েও সাড়া পাননি শিক্ষা উপদেষ্টা। ইউজিসিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে পাত্তা পাচ্ছে না। ফলে এ নিয়ে উচ্চশিক্ষায় সংকট দেখা দিয়েছে।

ইউজিসির সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জোর করতে পারি না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেই এখতিয়ার কিছুটা আছে। সেখান থেকে বারবার অনুরোধ করা হলেও কাজে আসছে না। সরকারকে এ নিয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। না হলে বড় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে।’

এখনো প্রায় সোয়া ১৮ কোটি বই ছাপানো বাকি। সক্ষমতা অনুযায়ী—দিনে ৩৫ লাখ করে বই ছাপালেও তা শেষ করতে প্রায় দুই মাস লাগবে। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীদের সব বই হাতে পেতে এপ্রিল মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই তুলে দিতে না পারায় বড় ধাক্কা খেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ নিয়ে চরম সমালোচনার মুখে পড়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। পরে জানুয়ারির মধ্যে সব বই দেওয়া হবে জানালেও তাতেও ব্যর্থ সরকার। জানুয়ারি মাস শেষ হলেও অর্ধেক বইও পায়নি শিক্ষার্থীরা। এতে স্কুলগুলোতে নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে না। বড় শিখন ঘাটতির মুখে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে শিক্ষক-অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ।

এনসিটিবি সূত্র জানায়, শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মিলিয়ে মোট ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ছাপা হয়েছে ২২ কোটি বই। সেগুলোর মধ্যে ১৮ কোটি বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছেছে। বাকি চার কোটি বই বিতরণ প্রক্রিয়াধীন।

অন্যদিকে এখনো ছাপানোর বাকি প্রায় সোয়া ১৮ কোটি বই। সক্ষমতা অনুযায়ী, দিনে ৩৫ লাখ করে বই ছাপালেও তা শেষ করতে প্রায় দুই মাস লাগবে। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীদের সব বই হাতে পেতে এপ্রিল মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান অবশ্য দাবি করেছেন যে, ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই তারা সব বই শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

সবশেষ প্রতিষ্ঠিত ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশের পর্যাপ্ত শিক্ষক, নিজস্ব ক্যাম্পাস, আবাসন ও ল্যাবসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই।

দেশে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৭০টি। যার মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৫টি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের ১৫ বছরে। সবশেষ প্রতিষ্ঠিত ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশের পর্যাপ্ত শিক্ষক, নিজস্ব ক্যাম্পাস, আবাসন ও ল্যাবসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই।

শিক্ষার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ, ল্যাব প্রতিষ্ঠাসহ অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন প্রয়োজন। তাতে দরকার বিপুল অর্থ বরাদ্দ, যা দিতে পারছে না সরকার। এতে নতুন এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার ন্যূনতম পরিবেশ নেই। এভাবে চললে কয়েক বছর পর সেগুলো বন্ধের উপক্রম হবে। বিষয়টি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই।

ইউজিসি সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই মানসম্মত হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল বা কিন্ডারগার্টেনের মতো হলে রাষ্ট্র লাভবান হবে না। গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগের অবস্থাই ভালো নয়। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা একেবারে সমাধান সম্ভব নয়, সেগুলোর বিষয়ে বিকল্প চিন্তা করা জরুরি।

সবশেষ প্রতিষ্ঠিত ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশের পর্যাপ্ত শিক্ষক, নিজস্ব ক্যাম্পাস, আবাসন ও ল্যাবসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই।

দেশে বর্তমানে চালু রয়েছে ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যার মধ্যে বিগত ১৫ বছরে চালু হয়েছে ৬১টি। সেখানে শিক্ষার মান নেই, চলছে রমরমা সনদ বাণিজ্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার তথা ইউজিসির তদারকি থাকার কথা। অথচ সেখানে সরকারের নিয়োগ করা উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেই। ফলে একাডেমিক ও প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতায় ডুবতে বসেছে।

ইউজিসির তথ্যমতে, বর্তমানে ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ- তিন পদই শূন্য। শুধু উপাচার্য নেই ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। উপাচার্য-উপাচার্য দুই পদ শূন্য এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৭টি।

ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘দ্রুত শূন্যতা পূরণে সরকারের শীর্ষমহল থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। খুব শিগগির এসব পদে নতুন নিয়োগ দেওয়া হবে।’

সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রম তদারকি করে ইউজিসি। বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে পরামর্শ দেয় সংস্থাটি। অথচ অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিজেই ধুঁকছে ইউজিসি। ৫ আগস্টের পর পদোন্নতি ঘিরে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। হাতাহাতিতেও জড়িয়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পদোন্নতিতে জ্যেষ্ঠতা ও চাকরির শর্ত না মানায় মূলত এ সমস্যার উদ্ভব।

জানা যায়, পূর্ণাঙ্গ কমিশন সবার আগে ধাপে ধাপে ৩৩ জনকে পদোন্নতি দেয়। এর মধ্যে এক অফিস আদেশেই ২৮ জনকে ব্যাকডেটে (পেছনের তারিখ) পদোন্নতি দিয়েছে ইউজিসি। এটি অবিশ্বাস্য উল্লেখ করে বঞ্চিতরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। এতে ইউজিসির ভেতরে-বাইরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করেও পারেননি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা বর্তমানে ১৩তম গ্রেডে বেতন-ভাতা পান। তারা দীর্ঘদিন ধরে দশম গ্রেডে বেতন-ভাতার দাবি জানিয়ে আসছেন। স্মারকলিপি, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচির পর সম্প্রতি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বড়োসড়ো সমাবেশ করেন তারা। ওই দিন তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে লংমার্চ করেন। পুলিশ তাদের আটকে দেয়। পরে শিক্ষকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বৈঠক করে দাবি বিবেচনার আশ্বাস দেন।

যদিও এসবের মধ্যেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার সিলেটে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করেন। উপদেষ্টা বলেন, ‘শিক্ষকতা না পোষালে তাকে অন্য পেশায় যেতে হবে।’

তার এমন বক্তব্যের পর সারাদেশে মানববন্ধন করেন প্রাথমিক শিক্ষকরা। শিগগির দাবি না মানা হলে তারা শ্রেণিকক্ষে তালা দিয়ে কর্মবিরতির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

পদত্যাগে বাধ্য হওয়া শিক্ষকদের এ আন্দোলনে নতুন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাদের সরিয়ে দেওয়ার পর যেসব শিক্ষক অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক পদে বসেছেন, তারা এ আন্দোলনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। দুই পক্ষ মুখোমুখি হওয়ায় অস্থিরতা আরও বাড়ছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। গত ১৫ জানুয়ারি পদত্যাগে বাধ্য হওয়া কিংবা হেনস্তার শিকার হওয়া শিক্ষকদের বেতন-ভাতা চালুর রাখার নির্দেশনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাতে বলা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধে জড়ানোর প্রমাণ না মিলবে, তাদের স্বপদে আবারও চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

সরকারের এমন সিদ্ধান্তে খুশি পদত্যাগে বাধ্য হওয়া প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষক। তবে নির্দেশনার পরও তা মানা হচ্ছে না অভিযোগ তুলে সম্প্রতি তারা আন্দোলনে নেমেছেন। শিক্ষা ভবনে দিনভর অবস্থান কর্মসূচিও করেন তারা। বেতন চালু রাখাসহ পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছেন তারা। পদত্যাগে বাধ্য হওয়া শিক্ষকদের এ আন্দোলনে নতুন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাদের সরিয়ে দেওয়ার পর যেসব শিক্ষকরা অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক পদে বসেছেন, তারা এ আন্দোলনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। দুই পক্ষ মুখোমুখি হওয়ায় অস্থিরতা আরও বাড়ছে।

‘সরকারের মধ্যে দুর্বল লোক থাকায় সবার আগে আমলারা সুযোগ নিয়েছেন। তাদের পদোন্নতি নেওয়া দেখে পুলিশও একই কাজ করলো। অন্যরাও ভাবলেন দাবি তুললে সেটি পূরণ করা যায়। সেই কারণেও আন্দোলনে নেমেছেন অনেকে।’- অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান

শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন পদে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা নিয়োগ পান। তাদের নিয়োগ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পদগুলোতে নিয়োগ দিয়ে বিতর্কের মুখে পড়ছে মন্ত্রণালয়। অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে সুবিধাভোগী এবং ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ ও বাম ধারার রাজনীতিতে জড়িতদের শিক্ষা প্রশাসনে পুনর্বাসন করছেন শিক্ষা উপদেষ্টা।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) সম্প্রতি যাকে মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তিনি ৫ আগস্টের পর ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে অধ্যক্ষ পদ থেকে প্রত্যাহার হয়েছিলেন। আবার এনসিটিবির চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকের মামাতো ভাইকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে সচিব পদে রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভাগনে। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) মহাপরিচালক পদেও আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধাভোগী কর্মকর্তাকে পদায়ন করার অভিযোগ উঠেছে।

বিএনপিপন্থি শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের অভিযোগ, শিক্ষা প্রশাসনে আওয়ামী লীগের দোসর অথবা জামায়াতের লোকেরা নিয়োগ পাচ্ছেন। বিএনপিপন্থি যোগ্য কর্মকর্তা থাকলেও তাদের বঞ্চিত করছে সরকার। এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে তাদের মধ্যে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, ‘সরকারের জনবল কম। একজন দিয়ে তিন-চারটা মন্ত্রণালয় চালানো কঠিন। সরকারের মধ্যে দুর্বল লোক থাকায় সবার আগে আমলারা সুযোগ নিয়েছেন। তাদের পদোন্নতি নেওয়া দেখে পুলিশও একই কাজ করলো। অন্যরাও ভাবলেন দাবি তুললে সেটি পূরণ করা যায়। সেই কারণেও আন্দোলনে নেমেছেন অনেকে। আবার রাজনৈতিক দলগুলোতেও লোকজন ভাগাভাগি হয়ে গেছেন। সরকারকে ব্যর্থ দেখানো ও বেকায়দায় ফেলার সব ধরনের ইন্ধনের পথ খোলা। ফলে শুধু শিক্ষাখাত নয়, কোনো খাতেই প্রত্যাশা অনুযায়ী সংস্কার দৃশ্যমান নয়।’

‘সরকারের প্রচেষ্টা নেই, এটা সত্য নয়। আমরা কাজ করছি। হয়তো সবাই যেভাবে চেয়েছিল, সেভাবে হচ্ছে না। রাতারাতি কোনো খাতই ঠিক করা সম্ভব নয়। সেখানে শিক্ষাখাতও অনেক বড়। শৃঙ্খলা ফেরানো ওতটা সহজ নয়।’- শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

শিক্ষা অনেক বড় খাত। রাতারাতি এখানে সংস্কার করা বা শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সোমবার রাতে তিনি বলেন, ‘সরকারের প্রচেষ্টা নেই, এটা সত্য নয়। আমরা কাজ করছি। হয়তো সবাই যেভাবে চেয়েছিল, সেভাবে হচ্ছে না। রাতারাতি কোনো খাতই ঠিক করা সম্ভব নয়। সেখানে শিক্ষাখাতও অনেক বড়। শৃঙ্খলা ফেরানো ওতটা সহজ নয়।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে মানসিক দূরত্বের বিষয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘এগুলো বানোয়াট। অনেকে দূর থেকে এগুলো মনে করেন। যারা দায়িত্বে রয়েছেন, তারা নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করছেন। এখানে কেউ কারও ওপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে না।’

হঠাৎ এসে কাজ করতে বেগ পোহাতে হচ্ছে বলে মনে করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী মর্যাদা) অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এখানে একটা সেটআপ থাকে। সেটা নিয়েই কাজ করতে হয়। প্রক্রিয়াগুলো জটিল ও আমলাতান্ত্রিক। ফলে যেভাবে প্রত্যাশা, সেভাবে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না; এটাই সত্য।’

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram