

জন্ম নিয়ে রং-রসের অভাব নেই। আবার মৃত্যু দিয়ে এমন সব ঘটনা রয়েছে, যা বিয়েশাদির কাহিনিকেও হার মানায়। পিতার মৃত্যুর পর মহাত্মা গান্ধীর কেন কান্না পায়নি এবং সে রাতে স্ত্রীর সাহচর্য পাওয়ার লোভে কিভাবে পিতৃশোক ভুলে গিয়েছিলেন তা প্রকাশ করার সাহস শুধু মহাত্মা গান্ধীর মতো মহামানবেরই থাকে। আমার মতো চুনোপুঁটিরা বড়জোর জন্ম ও বিয়ে নিয়ে হয়তো দু-চারটে মজার কাহিনি শোনাতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে মৃত্যুর মতো নির্মম ঘটনা নিয়েও মানুষের মধ্যে যে মতো রসায়ন থাকতে পারে তার কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ নির্মম হলেও আজ আমলাদের জানাব।
আমার বালকবেলায় সম্ভবত ১৯৭৩ সালে আমাদের গ্রামের একজন মুরব্বি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বহুদিন ভুগে মারা গেলেন। তাঁর চেহারা এতটা কঙ্কালসার এবং বিকৃত হয়ে পড়েছিল, যা দেখা মাত্র লোকজন আঁতকে উঠত। তাঁর দাফন কাফন জানাজার স্মৃতি মনে না থাকলেও শেষ মুহূর্তে কাফনের অংশ খুলে মুখ দেখানোর যে রেওয়াজ গ্রামবাংলায় ছিল তা করতে গিয়ে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে যে আতঙ্ক দেখেছিলাম তা আজও ভুলতে পারিনি।
জন্ম-মৃত্যু! নির্মম হলেও ঘটনা কিন্তু সত্যআমাদের শৈশবে বেশির ভাগ মানুষ ৩৫-৪০ বছর বয়সে বুড়ো হয়ে যেত।
মহিলাদের ক্ষেত্রে ৩০ বছর হলেই বুড়ির খাতায় নাম চলে যেত। আমার নানির বিয়ে হয়েছিল ১২ বছর বয়সে। পরবর্তী ১৮ বছরে তাঁর মোট ১৩ জন সন্তান পয়দা হলো, যাদের মধ্যে তিনজনের বয়স আমার চেয়ে ছোট। তো নানিকে একবার ঢাকা আনলাম চিকিৎসার জন্য।
কয়েক বছর ধরে তিনি একটি জটিল রোগে ভুগছিলেন, কিন্তু পরিবারের কেউ তাঁকে জোর করেও ডাক্তারের কাছে নিতে পারছিল না। অবশেষে সবাই যখন আমার কাছে সাহায্য চাইল তখন নানির সঙ্গে কথা বলে যেটা বুঝলাম—তিনি ডাক্তারদের খুব ভয় পান। কারণ বহু বছর আগে প্রথম যখন ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন তখন ডাক্তার সাহেব তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার ছেলেমেয়ে কয়টি?
নানি চিন্তা করলেন—এত অল্প বয়সে ১৩টি সন্তান প্রসব করেছেন এই কথা ডাক্তার শুনলে কী মনে করবেন। সুতরাং বুদ্ধি খাটিয়ে তিনি বললেন, আমার ১০টি সন্তান। ডাক্তার ভদ্রলোক সম্ভবত খ্যাপাটে ছিলেন।
তিনি প্রথমে নানাকে বকাঝকা করলেন, তারপর নানিকে বললেন—১০টা সন্তান জন্ম দিয়েছেন এই কথা বলতে একটুও লজ্জা করল না? নানি মাথা নিচু করে ভাবলেন—ভাগ্যিস, তিনজনের কথা গোপন করেছিলাম—নইলে কি যে হতো? ব্যস! সেদিনের পর আর কোনো দিন ডাক্তারের কাছে যাননি। তাঁর ভয় ছিল, ডাক্তার যদি আবার ওসব কথা জিজ্ঞেস করে তখন কী হবে। পুরো কাহিনি শোনার পর আমি নানির বুদ্ধির প্রশংসা করলাম এবং নিশ্চয়তা দিলাম যে আর ওসব প্রশ্ন করবে না। আমার কথা বিশ্বাস করে তিনি শেষমেশ ডাক্তার দেখাতে রাজি হলেন। নানির প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে এবার নিজের কথা বলি। আমার যখন জন্ম হলো তখন আমাদের গ্রামের ধনী পরিবারগুলোর একটি রেওয়াজ ছিল। নবজাতকের জন্য একটি দুগ্ধবতী বকরি কেনা হতো এবং মাতৃদুগ্ধের পাশাপাশি ছাগলের দুধ পান করানোকে এক ধরনের বাহাদুরি মনে করা হতো। একটু বড় হওয়ার পর যখন আমি জানলাম যে শৈশবে আমাকে ছাগলের দুগ্ধ পান করানো হয়েছে তখন ছাগলদের প্রতি আমার দরদ বেড়ে গেল। পরবর্তীকালে সেই দরদের কারণে বহুদিন পর্যন্ত আমি ছাগলের মাংস খাইনি। দ্বিতীয়ত, আজ অবধি যখন নিজের কোনো নির্বুদ্ধিতা-ভুলভ্রান্তির জন্য ক্ষতির সম্মুখীন হই তখন নিজের অজান্তে কেন জানি মনে হয় ছোটকালে ছাগলের দুধ না খেলে আমার বুদ্ধিশুদ্ধি হয়তো আরেকটু ভালো হতো।
বিয়ের কথা বলব তার আগে মৃত্যুর প্রসঙ্গ নিয়ে আরো কিছু বলে নিই। সত্তরের দশকের বাংলায় ঘরে ঘরে বুড়োবুড়িদের আধিক্য ছিল চোখে পড়ার মতো। সামান্য রোগ ভোগের পর ৪০-৪৫ বছর বয়সে অনেকে বিছানায় পড়ে যেতেন। অপুষ্টি, অশিক্ষা, অভাব-অভিযোগ এবং চিকিৎসার অভাবে তাঁরা আর সেরে উঠতেন না। বেশির ভাগ লোক ১০-১৫ বছর শয্যাশায়ী থেকে যখন মারা যেতেন তখন তাঁদের জন্য কান্না করার লোক পাওয়া যেত না। আমার দাদা যখন মারা গেলেন তখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। দাদাও প্রায় দেড় যুগ শয্যাশায়ী ছিলেন। আমার বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও তাঁর জীবনের শেষ দুই বছর আমি তাঁকে নিবিড়ভাবে সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। দাদার খাওয়াদাওয়া, গোসল, পায়খানা-প্রস্রাব পরিষ্কার, মাথায় পানি দেওয়া ইত্যাকার কাজ আমিই করতাম।
দাদার সঙ্গে আমার ছিল চমৎকার একটি সম্পর্ক। আমার শৈশবের শিক্ষা এবং জীবনের তাবৎ নৈতিক শিক্ষার শুরুটা হয়েছিল দাদার হাত ধরে। গল্প বলা থেকে শুরু করে কালামে পাকের তাফসির, মসজিদে যাওয়া থেকে শুরু করে হাটবাজার, কেনাকাটা ইত্যাদি সব কর্মে দাদার স্মৃতি আমাকে আজও প্রভাবিত করে। অথচ সেই দাদা যেদিন মারা গেলেন সেদিন আমার একটুও কান্না পেল না। অথচ দাদার জন্য পুরো গ্রাম কাঁদল। সবাই আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল। কারণ দাদার সঙ্গে আমার যে হৃদ্যতা এবং আমার যে ছিঁচকাঁদুনে স্বভাব তাতে করে আত্মীয়-স্বজন মনে করল আমি হয়তো কাঁদতে কাঁদতে মরেই যাব। উল্লিখিত অবস্থায় আত্মীয়রা আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রচলিত নিয়মে কাঁদলেন। ফুফু-দাদি-কাকা-মা সবাই কাঁদলেন, কিন্তু আমার কান্না পেল না। তাঁরা মনে করলেন আমি হয়তো অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছি। লোকজনের মনোভাব বুঝতে পেরে আমার অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল। আমি কান্নার জন্য চেষ্টার পাশাপাশি দোয়াও শুরু করলাম, কিন্তু কান্না এলো না। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আমি উঠানের একটি গাছের সঙ্গে সজোরে মাথা ঠুকতে আরম্ভ করলাম। আমার অবস্থা দেখে আত্মীয়-স্বজন ছুটে এলেন—ভাবলেন আমি বোধ হয় পাগল হয়ে গেছি। বয়স্করা আমাকে ধরে শোয়ালেন, তারপর বিলাপ করতে করতে আমার মাথায় যখন পানি ঢালতে আরম্ভ করলেন তখন কেন জানি আমার মধ্যে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো কান্নার ঢল চলে এলো এবং সম্ভবত আমি একসময় জ্ঞানও হারিয়ে ফেললাম।
মৃত্যুর ঘটনা বাদ দিয়ে চলুন আবার জন্ম নিয়ে একটু ফ্যান্টাসি করে আসি। আমি শৈশবে সারাক্ষণ ভূতের ভয়ে কাঁপতাম আর গল্পে জিন-পরিদের কথা শোনার পর মনে মনে ভাবতাম—ইস, যদি পরিস্থান থেকে কোনো পরি এসে আমাকে তুলে নিয়ে যেত, তাহলে না জানি কতই না ভালো হতো। পরিরা ফুলের বাগানে সকালে-বিকালে আসে এমন বিশ্বাস থেকে মাঝেমধ্যে ফুলের বাগানে দাঁড়িয়ে থাকতাম এবং পরির প্রেমের অনুভূতি থেকেই আমার মধ্যে বিয়ের ইচ্ছে প্রবল হলো। আমাদের সময়ে শৈশবকালে অহরহ বিয়ে হতো। কাজেই সুন্নতে খতনার আগেই এবং নারী-পুরুষের রসায়ন অনুভবের আগেই মনে হতো ইস আমার যদি বিয়ে হয়ে যেত, তবে না জানি কত ভালো হতো। একদিন দাদিকে বললাম বিয়ের কথা। তিনি বললেন, বিয়ে করতে হলে তো আগে মুসলমানি করতে হবে।
দাদির কাছে মুসলমানি বা সুন্নতে খতনার বিস্তারিত শুনে আমার সেই যে হাটু কাঁপুনি শুরু হলো, তা কবে থেমেছিল তা আজ আর মনে নেই। তবে দাদির কথার পর আর বিয়ের কথা মনে হয়নি। বরং বারবার মনে হয়েছে ছেলে না হয়ে মেয়ে হলেই হয়তো ভালো ছিল।
জীবনের পথ পরিক্রমায় আজ প্রায় পাঁচ যুগ পার করে প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়েছি। বহু জন্ম-বহু মৃত্যু কাছ থেকে দেখেছি। কখনো কখনো কোনো মৃত্যু হৃদয়ে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে আবার নতুন কোনো শিশুর আগমনে পৃথিবীর চাঁদ স্পর্শ করার কল্পিত সুখ অনুভব করেছি। জীবনের নির্মম বাস্তবতায় বহুবার বহু মৃত্যুশোক নিয়ে মাতম করতে পারিনি। আবার অনেকের ভূমিষ্ঠ হওয়ার আনন্দের ছন্দে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। জন্ম ও মৃত্যু নিয়ে বহু পিলে চমকানো কাহিনি শুনেছি, সেগুলোর মধ্যে ইতিহাসের জনক হিরোডোটাস বর্ণিত দুটো কাহিনি বর্ণনা করে আজকের নিবন্ধ শেষ করব।
প্রথম কাহিনিটির সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। একটি বিশেষ অঞ্চলের লোকজনের মধ্যে প্রচলিত প্রথা বর্ণনা করতে গিয়ে হিরোডোটাস উল্লেখ করেন যে লিডিয়া এবং লিডিয়া সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী একটি অঞ্চল দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি শুনতে পেলেন যে ওই এলাকার বাসিন্দা তাদের মৃত পিতা-মাতার মাংস দিয়ে ভোজ উৎসব করে। কোনো পিতা-মাতা মারা গেলে সন্তানরা শোক প্রকাশের পরিবর্তে আনন্দ করত এবং মৃত ব্যক্তির মাংস রান্না করে পাড়া-প্রতিবেশীদের জিয়াফত করত।
দ্বিতীয় ঘটনাটির সঙ্গে বিশ্বরাজনীতির এক ঐতিহাসিক নির্মমতার অন্ত্যমিল রয়েছে। মহামতি সাইরাস দা গ্রেটের নানা ছিলেন লিডিয়ান সাম্রাজ্যের সম্রাট, যার প্রধান সেনাপতির নাম ছিল হারপাগাস। সম্রাট অস্তাইয়াজেস তাঁর সেনাপতি হারপাগাসের ওপর যারপরনাই বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ হলেন। তাঁকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য সেনাপতির কিশোর পুত্রকে ধরে আনলেন এবং জবাই করে কিশোরের মাংস উত্তমভাবে রান্না করলেন। তারপর নৈশভোজে সেনাপতিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সেই মাংস খেতে দিলেন।
সেনাপতি একান্ত বাধ্য, অনুগত এবং সম্মানিত মেহমানরূপে হাসিমুখে খাবার টেবিলে বসলেন এবং সম্রাটের মনোরঞ্জনের জন্য তৃপ্তি সহকারে নৈশভোজ সম্পন্ন করলেন। সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন, রন্ধন কেমন হয়েছে। সেনাপতি কুর্নিশ করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, অতি উত্তম। সম্রাট দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন, আপনি বুঝতে পেরেছেন এতক্ষণ কিসের মাংস ভক্ষণ করলেন। সেনাপতি মাথা নিচু করে জবাব দিলেন গর্দানের মালিকের কসম। আমি অবশ্যই বুঝতে পেরেছি। এবার অনুমতি পেলে আমি বাড়ি ফিরতে চাই।
সম্রাটের অনুমতির পর হারপাগাস প্রাসাদ থেকে বের হয়ে সোজা পারস্যে পালিয়ে গেলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে সেই ঘটনা ঘটালেন, যা ভারতবর্ষে চাণক্য ওরফে কৌটিল্য ঘটিয়েছিলেন—পারস্যের হারপাগাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আরো ৩০০ বছর পরে।
প্রতিটি জন্ম এবং মৃত্যুর নেপথ্যে একটি করে ইতিহাস থাকে এবং সেইসব ইতিহাসে যখন হারপাগাস অথবা চাণক্যদের মতো বুদ্ধিমানরা আক্রান্ত হন তখন একটি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং আরেকটি যুগান্তকারী সাম্রাজ্যের অভ্যুদয় হয়। পারস্যের সাইরাস দ্য গ্রেট এবং ভারতের চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উত্থানের পেছনে দুটি মৃত্যু এবং দুজন মহান বীরের অনবদ্য প্রতিশোধের যে ইতিহাস রয়েছে সেখান থেকে আমরা কিছু না শিখলেও আমার মতো অধমের জন্ম-মৃত্যুসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা হয়তো কিছুটা হলেও রসায়ন সৃষ্টি করবে।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক

