

দেশ জুড়ে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। গবেষণায় দেখা যায়—গ্র্রামাঞ্চলে প্রতিদিন পাঁচ বছরের কমবয়সি প্রায় ৩০ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত যে সময়টায় মা ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকেন, সে সময় পানিতে, আগুনে পড়াসহ নানা রকম দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটে শিশুদের। এ বাস্তবতায় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং সাঁতার শেখা (ইন্টিগ্রেটেড কমিউনিটি-বেইজড চাইল্ডকেয়ার—আইসিবিসি) প্রকল্প পরিচালনা করছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে সিনারগোস বাংলাদেশ।
নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার চন্দনবাড়ী কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, এখানে স্থানীয়দের আগ্রহ আর শিশুদের আনন্দে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। শিশু সিহাব জানায়, তার কেন্দ্রে আসতে খুব ভালো লাগে। মা মাসুদা বেগম জানান, প্রতিদিন সকালে কাজে যাওয়ার আগে তার চার বছরের ছেলে রাফিদকে ‘শিশুযত্ন কেন্দ্রে’ রেখে যান। তিনি বলেন, ‘সেন্টারেই রাফিদ শেখে, খেলে, আনন্দে নিরাপদ থাকে। এখন আর ছেলেকে নিয়ে কোনো বিপদের ভয় হয় না।’
প্রান্তিক নারীদের জীবনে স্বস্তি এনে দিচ্ছে এই শিশুযত্ন কেন্দ্রগুলো। বর্তমানে ১৬ জেলার ৪৫টি উপজেলায় ৬৫ হাজার ‘শিশুযত্ন কেন্দ্র’ পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশুদের নিরাপদ দিবাযত্নের সুযোগের পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ছয় থেকে ১০ বছর বয়সী ছেলে ও মেয়েশিশুদের পৃথকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে ‘নিরাপদ সাঁতার’। প্রতিটি যত্ন কেন্দ্রে এক থেকে পাঁচ বছর বয়সের ২৫ জন শিশু থাকে।
এখানেই শিশুযত্ন কেন্দ্রে নারীরা প্রশিক্ষিত সেবাদানকারী ও মেয়েদের সাঁতার প্রশিক্ষক হিসেবে কাজেরও সুযোগ পাচ্ছেন। নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলায় ৫০০টি কেন্দ্রে ১২ হাজারেরও বেশি শিশু পাচ্ছে এই সেবা। কেন্দ্রের কেয়ারগিভার কামরুননাহার জানান, তার বাড়ির পাশে একটুকরো জমি তিনি শিশু যত্ন কেন্দ্রের জন্য দান করেছেন। তার নিজের চার বছরের ছেলেসহ অন্য শিশুদের যত্ন নেওয়ার কাজটা বেশ উপভোগ করেন। তার আয়ের দরজাও খুলেছে।
সিনারগোস বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর এশা হুসেইন মনে করেন, এই প্রকল্পের সবচেয়ে সুন্দর দিক হচ্ছে, স্থানীয়দের দ্বারাই প্রকল্প পরিচালিত হয় এবং স্থানীয়রা নানাভাবে ভূমিকা রাখে। যেমন শিশুযত্ন কেন্দ্রটির জন্য কোনো ঘর কেনা বা ভাড়া নেওয়া হয় না। এটা স্থানীয়রাই দেয়। এই ঘর দেওয়ার বিষয় আগ্রহও অনেক। শিশুরা হালকা নাশতাও বাড়ি থেকে নিয়ে আসে। কেন্দ্রে শিশুদের বিকাশও ভালো হয়। কেন্দ্রের শিশুরা দ্রুত জড়তা কাটিয়ে কথা বলে।
প্রতিটা সেন্টারেই এক/দুই জন প্রতিবন্ধী শিশু শনাক্ত হয়। ফলে তারা দ্রুতই তাদের প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে জানতে পারে—এসব অনেক বিবেচনায় প্রকল্পটি অনন্য। প্রকল্প পরিচালক আব্দুল কাদির জানান, আরো ১৫ জেলায় এ প্রকল্প সম্প্রসারণের পরিকল্পনা আছে। তিনি বলেন, ‘যেসব এলাকার শিশুরা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত, দরিদ্র ও ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি—যেমন সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, বাগেরহাট, চাঁদপুর ও ভোলা। সেইসব এলাকায় আমরা কাজ করতে চাই। সরকার এরই মধ্যে দ্বিতীয় ধাপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ আব্দুল কাদির বলেন, ‘প্রকল্পে শিগগিরই শিশুদের চোখ পরীক্ষা ও চিকিৎসার বিষয়টি যুক্ত করা হবে।’ তিনি বলেন, অনেক শিশু সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে দৃষ্টি হারায়।

