পরিতোষ দাস, মদন (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি: মদন উপজেলার নদী, খাল ও বিল এখন বেশিরভাগই প্রভাবশালীদের দখলে। ২শ ২৫দশমিক ৮৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে মদন উপজেলা। মগড়া ধলাই, কৈজানী, বর্ণি, ছিনাই, বয়রাহালা, ঘন্টাবতীসহ ১০ নদী দ্বারা বেষ্টিত এ উপজেলা। চতুর্দিকে প্রবাহিত নদীগুলোর সাথে ২০টি খাল ও ৪৩টি হাওড় বিল ছড়িয়ে রয়েছে।
এক সময় মিঠা পানির মাছের জন্য বিখ্যাত ছিল মদন উপজেলা। ধান, পাট, সরিষার আবাদও হতো প্রচুর। স্থানীয় জনগণের চাহিদা পূরণ হয়েও উদ্বৃত্ত ফসল রপ্তানী করা হতো। বিভিন্ন হাট বাজারগুলোতে রমরমা ব্যবসা ছিল। নদী, খাল-বিল প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাওয়ায় পানি শুকিয়ে নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে পরিণত হয়েছে সরু নালায়। আর খাল-বিল শুকিয়ে ফসলী জমিতে পরিণত হয়েছে। নদী, খাল-বিলের এই পরিণতিতে এসব পথে নৌচলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রভাবশালীরা সবকিছু তাদের দখলে নিয়ে চাষাবাদ করছে। বিশেষ করে সড়ক পথ গড়ে তোলার সময় নৌ পথের চিন্তা না করায় এ দুরাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে এলাকার অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।
এক সময় নদী ও খাল বিল থেকে মাছ ধরে এলাকার হতদরিদ্র ও জেলে পরিবারের লোকজন জীবিকা নির্বাহ করত। বর্তমানে এ উপজেলার ৪ হাজার ৬শ তিন জেলে পরিবার বেকার হয়ে অর্ধাহারে অনাহারে জীবন যাপন করছে। নদী, খাল-বিলে হাইব্রিড ধান চাষ ও অতিমাত্রায় সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করায় এসব এলাকা থেকে মিঠা পানির অনেক প্রাণী, উদ্ভিদ ও মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বক, পানকৌড়ি, বালিহাঁস ও অনেক ধরণের অতিথি পাখি, লাল শাপলা, ভেপ, শালুক, সিংড়া, পদ্ম পাতা, কচ্ছপ, কাছিম, শুশক, ভোদর, গুই সাপ, নানা প্রজাতির সাপ, চাপিলা, রুই, মৃগেল, টাকি, চিতল, রিটা, খলিসা, পাংগাশ, রাণী, বৈচা, ফলি, চেংমাছ, বাঘাইর, সিলং, লাছু, গলদা চিংড়ি, ডিমা চিংড়ি, টাটা মাছ, নানিত, তারা বাইন, ঘাউড়া, কাইক্কা, বাতাই ইত্যাদি মিঠা পানির মাছ হাট বাজারগুলোতে এখন আর দেখা যায় না। তবে পুকুরে চাষের মাছ পাওয়া যায়। আগে নদী, বিল খালে মাছ ধরলে কারো অনুমতি বা টাকা দেয়া লাগত না। জেলে পরিবারের লোকজন সহজেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে পারত। এগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় এদের মাছ ধরার কোন সুযোগ নাই। মাছে ভাতে বাঙালী হলেও দেশী মাছ কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে নদী খাল বিলের সাথে বেঁচে থাকার অনেক পেশা।
অন্যদিকে গ্রাম বাংলার নদী, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় কৃষকদের সেচ ব্যবস্থায় দেখা দিচ্ছে সংকট। সেচের অভাবে সঠিক সময়ে ফসল ফলাতে পারছে না তারা। আগে কম খরচে নদী, খাল-বিল থেকে কোন, উছা ও পাওয়ার পাম্পে পানি তুলতে পারতো। এখন অনেক ব্যয়ে গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ দিতে হচ্ছে। নদী খাল বিল হারিয়ে গেলে মানুষের অনেক দুর্ভোগ বাড়বে। ইতিমধ্যে ধলাই, বন্নী, ঘন্টাবতী, বয়রাহালা নদী, যাত্রা খাল, আলহেলালী খাল, হাতি, হিংলাবিলসহ প্রায় সবগুলো খাল বিলের অস্থিত্য বিলুপ্তির পথে।
ফতেপুর ইউপি চেয়ারম্যান সামিউল হায়দার সফি জানান, দ্রুত নদী, খাল-বিলগুলো খননের ব্যবস্থা করলে সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে। বিলুপ্ত প্রায় নদী, খাল-বিলগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত খনন করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
বারসিক এনজিওর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী ও পরিবেশকর্মী মোঃ অহিদুর রহমান জানান, নদী খাল-বিল অবৈধ দখলদারিত্বে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। নদী, খাল-বিলগুলো খনন করলে এর সুফলতা আসবে। হাওরে ক্রস গাছ রোপন এবং পরিচর্যা, নিচু জমিতে অতিমাত্রায় বিষ কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। মৎস্য সংরক্ষণে পানি শুকিয়ে ও বিল প্রয়োগ করে মাছ নিধন বন্ধ করতে হবে। অভয়াশ্রম তৈরি ও সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করলে জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ ও মৎস্য সম্পদ রক্ষা পাবে। এদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি প্রয়োজন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অহনা জিন্নাত জানান, অবৈধ দখলে নেয়া নদী, খাল-বিল চিহ্নিত করে অচিরেই উদ্ধার করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।