আমদানি করা গাড়ির ৮০ শতাংশ মোংলা বন্দর দিয়ে খালাসের প্রস্তাব দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন গাড়ি আমদানিকারকরা। তারা বলছেন, বন্দরের প্রস্তাবনা কার্যকর হলে বেশি ক্ষতির শিকার হবেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া পুরো সেক্টরটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পুরোনো বিলাসবহুল গাড়ি আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের পর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি শুরু হয়। বিশেষ করে জাপান থেকে সবচেয়ে বেশি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশন সংক্রান্ত কিছু জটিলতার কারণে পরে মোংলা বন্দর দিয়েও গাড়ি আমদানি শুরু হয়। বর্তমানে ৮০ শতাংশের কাছাকাছি মোংলা দিয়ে আমদানি হলেও সেটা কোনো আদেশের বলে হয় না। মন্ত্রণালয় সম্মতি জানালে তখন বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে। যেটা ব্যবসায়ীরা চান না।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বছরে গড়ে ১১ হাজার গাড়ি আমদানি হয়। বর্তমানে আমদানি করা বিলাসী গাড়ি রাখার জন্য বন্দর অভ্যন্তরে একটি এবং বাইরে একটি শেড রয়েছে। শেড দুটির গাড়ি ধারণক্ষমতা এক হাজার ২৫০টি। গাড়ি খালাসে প্রতি মাসে কমবেশি ২৫০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করে কাস্টমস।
রিকন্ডিশন্ড গাড়িগুলো জাপান থেকে আমদানি করা হয়। রিকন্ডিশন্ড হলেও গাড়িগুলো নতুন ও চকচকে থাকে। কিন্তু মোংলা বন্দর দিয়ে এসব গাড়ি খালাস করতে গেলে অনেক গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়। পরে এসব গাড়ি অর্ধেক দামেও গাড়ি বিক্রি করা সম্ভব হয় না।-চট্টগ্রামের গাড়ি আমদানিকারক মো. হারুন
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত প্রস্তাবনার চিঠিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ি রাখার শেডগুলো মাল্টিস্টোরেড না হওয়ায় গাড়ির সংখ্যার অনুপাতে অধিক স্থান দখল করে, যার তুলনায় রাজস্ব আয়ও কম হয়। পাশাপাশি প্রতি বছর কিছু কিছু গাড়ি কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমদানিকারকদের আইনি জটিলতার কারণে খালাস না হওয়ায় বন্দরের জায়গা দখল করে পড়ে থাকে। এতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আদায়যোগ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।
তিন-চারটি কনটেইনার একটির ওপর আরেকটি রাখা যায়। এতে সমপরিমাণ জায়গায় গাড়ির তুলনায় অধিক কনটেইনার রাখা যায়। এতে তুলনামূলকভাবে বন্দরের রাজস্ব আয়ও বাড়বে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি কনটেইনার সংখ্যা প্রতি বছর দ্রুত বাড়ছে। সে তুলনায় কনটেইনার সংরক্ষণের স্থান সংকুচিত হয়ে পড়ছে বলে প্রস্তাবনার চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
বারভিডা সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খালাস হওয়া প্রতিটি গাড়ির ক্ষেত্রে প্রথম চারদিন মাশুল না থাকলেও পরবর্তী সাতদিন দিনপ্রতি ৭৯৩ টাকা ভাড়া ও ৫০৩ টাকা করে চার্জ দিতে হয়। ১৪ দিন পর দৈনিক হারে ৭শ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। কিন্তু মোংলা বন্দরে প্রথম চারদিন বিনা মাশুলে হলেও পরবর্তী সাতদিনের জন্য প্রতিদিন ৪শ টাকা এবং পরবর্তী সাতদিনের জন্য ৭৬৮ টাকা, আরও ১৪ দিন পর প্রতিদিনের জন্য ১২৯ টাকা ভাড়া দিতে হয়।
আমদানি করা রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ৮০ শতাংশ মোংলা বন্দর দিয়ে খালাস নিতে গেলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণ হবে। আমরা পুরোনো গাড়ি আমদানিকারকরা চাই সবকিছু ন্যায্যতার ভিত্তিতে নির্ধারণ হোক।- বারভিডার কোষাধ্যক্ষ ও আমদানিকারক সাইফুল আলম
শুল্ক তুলনামূলক কম হলেও চট্টগ্রামের আমদানিকারকরা চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই গাড়ি খালাস করতে আগ্রহী। তাছাড়া মোংলা বন্দর দিয়ে খালাস করা গাড়ি চট্টগ্রামে আনতেও জটিলতার মুখোমুখি হতে হয় বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।
চট্টগ্রামের গাড়ি আমদানিকারক ব্যবসায়ী জাকিয়া ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মো. হারুন বলেন, ‘রিকন্ডিশন্ড গাড়িগুলো জাপান থেকে আমদানি করা হয়। রিকন্ডিশন্ড হলেও গাড়িগুলো নতুন ও চকচকে থাকে। কিন্তু মোংলা বন্দর দিয়ে এসব গাড়ি খালাস করতে গেলে অনেক গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়। পরে এসব গাড়ি অর্ধেক দামেও গাড়ি বিক্রি করা সম্ভব হয় না।’
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ি খালাসের পর প্রথম চারদিন চার্জ ফ্রির কথা থাকলেও কয়েক ধরনের ফি রয়েছে, যেগুলো ফিক্সড। সে হিসেবে দুই হাজার সিসির নিচের গাড়ির জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম সাতদিন প্রতিদিন ২২৭ টাকা করে, অষ্টম দিন থেকে ১৮তম দিন পর্যন্ত দৈনিক ৫৬৫ টাকা করে এবং ১৯তম দিন থেকে ৯০৬ টাকা করে চার্জ দিতে হয়। দুই হাজার সিসির ওপরে হলে এ চার্জ আরও বাড়তি থাকে। একইভাবে মোংলা বন্দরে প্রথম ১৭ দিন বন্দর অভ্যন্তরে খোলা জায়গায় গাড়ি রাখলে তিন হাজার ৫শ টাকা, শেডের মধ্যে রাখতে চার হাজার ৫শ টাকা। এরপর প্রতি গাড়িতে প্রতিদিন হিসাবে ৩৪০ টাকা এবং ৬৮০ টাকা হারে চার্জ দিতে হয়।’
চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ি না এনে যদি সেগুলো মোংলা বন্দরের মাধ্যমে আনা হয়, তাহলে মোংলা বন্দরের জায়গাটা ব্যবহারে এলো। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরের অপারেশনাল কার্যক্রম সুচারুরূপে করা সম্ভব হবে। কারণ গাড়ি রাখার জায়গাটি যদি কনটেইনার রাখার কাজে ব্যবহার করা যায়, তাহলে বন্দরের আয় ও গতিশীলতা দুটোই বাড়বে।-চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক
পুরোনো গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) কোষাধ্যক্ষ ও আমদানিকারক মেসার্স অটো লিংকের স্বত্বাধিকারী সাইফুল আলম বলেন, ‘আমদানি করা রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ৮০ শতাংশ মোংলা বন্দর দিয়ে খালাস নিতে গেলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণ হবে। আমরা পুরোনো গাড়ি আমদানিকারকরা চাই সবকিছু ন্যায্যতার ভিত্তিতে নির্ধারণ হোক।’
আমদানিকারক এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘রিকন্ডিশন্ড অটোমোবাইল গাড়ির ব্যবসাটা শুরু হয় চট্টগ্রাম থেকেই। পরে সারাদেশে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানির ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়। যেখান থেকে শুরু, সরকারি সিদ্ধান্তে যদি সেখান থেকে অন্য জায়গায় ব্যবসার কেন্দ্র সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে এ খাতের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এখানে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। চট্টগ্রাম ঘিরে এটা একটি শিল্প। যে কারণে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের মধ্যে চট্টগ্রামের বেশি। বন্দরের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে ব্যাংক বিমা থেকে শুরু করে এ খাতে সম্পৃক্ত সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ি রাখার জন্য পড়ে থাকা খালি জায়গায় নতুন নতুন শেড তৈরি করুন। ব্যবসায়ীরা বন্দরের চার্জ দিয়েই বন্দর থেকে গাড়ি খালাস নেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ একগুঁয়েমি করে ব্যবসাটা মোংলা পাঠাতে চাইছেন। এ সিদ্ধান্ত চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা মানবে না।’
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, বুধবার (১৮ জুন) সবশেষ তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরের দুই শেডে বর্তমানে আমদানি করা ৯৮৫টি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি খালাসের অপেক্ষায়। গত ১৬ জুন ৮২২টি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে মাদার ভ্যাসেল ‘এমভি মালয়েশিয়ান স্টার’। জাহাজটি এর মধ্যে ৩৮২টি গাড়ি চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস করে বন্দর ত্যাগ করেছে। অবশিষ্ট গাড়িগুলো মোংলা বন্দরে খালাসের কথা রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর এড়িয়ে আমদানি করা রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ৮০ শতাংশ মোংলায় খালাস হলে চট্টগ্রাম বন্দর উপকৃত হবে বলে দাবি চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুকের। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ি না এনে যদি সেগুলো মোংলা বন্দরের মাধ্যমে আনা হয়, তাহলে মোংলা বন্দরের জায়গাটা ব্যবহারে এলো। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরের অপারেশনাল কার্যক্রম সুচারুরূপে করা সম্ভব হবে। কারণ গাড়ি রাখার জায়গাটি যদি কনটেইনার রাখার কাজে ব্যবহার করা যায়, তাহলে বন্দরের আয় ও গতিশীলতা দুটোই বাড়বে।’