জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বরগুনায় ভূ-উপরিস্থ ও ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা ও পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুমে চরম পানি সংকটে ভোগেন উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা। পানি সংকট দূর করতে পতিত সরকার ‘উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। তবে সেই প্রকল্পের কয়েকটি ধাপে ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে এসেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, তালিকা প্রস্তুত থেকে ট্যাংকি বিতরণ পর্যন্ত পাঁচটি ধাপে দুর্নীতি হয়েছে। ঠিকাদারের সাথে সমন্বয় করে খোদ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অনেকটা না দেখার ভান করে আছেন দৃশ্যমান সকল অনিয়ম-দুর্নীতি।
পায়রা-বলেশ্বর ও বিষখালী নদী বেষ্টিত দেশের সর্ব দক্ষিণের উপজেলা বরগুনার পাথরঘাটা, এরপরেই বঙ্গোপসাগর। পানির মধ্যে বসবাস, তবুও সুপেয় পানির তীব্র সংকট। মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততায় শুধু খাবার অযোগ্য নয়, এই পানি পুরোপুরি ব্যবহারেরও অনুপযোগী।
পানির চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন দেড় কিলোমিটার পথ হেঁটে বরগুনার পাথরঘাটার পদ্দা বেড়িবাঁধ থেকে পাশের গ্রাম পদ্দা এলাকায় সুপেয় পানি নিতে যান ৬০ বছরের বৃদ্ধ ধলু মিয়া। এক শিক্ষকের উদ্যোগে ব্যক্তিগতভাবে স্থাপন করা এই ফিল্টার থেকে প্রতিদিন ৩৫ লিটার সুপেয় পানির জার কাঁধে নিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরেন তিনি।
সরেজমিনে দেখা যায়- শুধু ধলু মিয়া নন, গোটা পদ্দা গ্রামের বাসিন্দাদের সুপেয় পানি সংগ্রহের চিত্র এটি। কখনো দিনের শুরুতে আবার কখনো দিনের শেষে লাইনে দাঁড়িয়ে সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে হয় তাদের।
এলাকাবাসী জানান, পানিতে লবণাক্ততা ও নলকূপ স্থাপনের সুযোগ না থাকায় বৃষ্টি মৌসুম শেষ হলেই এভাবেই ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের।
পদ্দা এলাকার ইয়াকুব হোসেন, হুমায়ূন কবির, বশির হাওলাদারসহ একাধিক বাসিন্দা বলেন, “এই এলাকার চারপাশে পানি থাকলেও সুপেয় পানির দারুণ সংকট। নদী ও খালের পানি এতটাই লবণাক্ত যা মানুষতো দূরের কথা, গবাদি পশুকেও পান করানো যায় না। বছরের অন্তত পাঁচ মাস পানির সংকটে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়।”
সুপেয় পানির তীব্র সংকট বরগুনার সদরের নলটোনা ইউনিয়ন ও বালিয়াতলী ইউনিয়নের একাংশে। এখানকার বাসিন্দারা সুপেয় পানির সংকটে লবণাক্ত পানি পান করে পানি বাহিত নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা লবণাক্ত পানি পান করছেন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জল ও বায়ু গবেষক ড. হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, “জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টিসহ নানান কারণে পানিতে লবণাক্ততা বেড়েছে। লবণাক্ততা কমাতে সরকারকে বহিঃবিশ্বের সাথে সমন্বয় করে পরিকল্পিত উদ্যোগের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন রোধের পাশাপাশি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এসব লবণ পানি পান ও ব্যবহার করা থেকে উপকূলীয় বাসিন্দাদের বিরত থাকতে ব্যাপকহারে প্রচারণা দরকার। পানির প্রতি মিলিয়ন অংশে লবণের মাত্রা ৬০০ পিপিএম পর্যন্ত থাকলে সে পানি খাবার উপযোগী ধরা হয়। তবে পাথরঘাটায় ভূ-গর্ভস্থ পানিতে লবণের মাত্রা প্রায় ৩০০০ পিপিএম, যা পুরোপুরি পানের অযোগ্য।”
এই সংকট দূর করতে উপকূলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্প থাকার পরেও কেনো কাটছে না সংকট! এমন প্রশ্নের উত্তর পেতে আবারও ফিরতে হবে ধলু মিয়ার কথায়।
পদ্দা এলাকার বাসিন্দা সেই ধলু মিয়া বলেন, “আমরা গরিবরা এই প্রকল্পের সুবিধা পাই না। কারণ টাকার বিনিময়ে তালিকা করেছে আওয়ামী লীগ সরকার ও তার চ্যালারা।”
ধলু মিয়ার মতোই বরগুনা উপকূলের অন্তত ছয় লাখ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে। সংকট নিরসনে ২০২২-২০২৩ ও ২৩-২৪ অর্থ বছরে পৃথকভাবে তিনটি প্যাকেজে ৭৫৬০ জনের নামের সুপারিশ করেন তৎকালীন বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, বরগুনা সদরের উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম, বরগুনা-২ আসনের সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমন, বামনার উপজেলা চেয়ারম্যান সাইতুল ইসলাম লিটু ও প্রকল্পের আওতাধীন ইউপি চেয়ারম্যান এবং সদস্যরা।
তথ্য অধিকার আইনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, গত দুই অর্থ বছরে পৃথকভাবে তিনটি প্যাকেজে ৩৪ কোটি ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার ৩৬০ টাকায় টেন্ডার পায় বরগুনার কামাল এন্টার প্রাইজ।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, পাঁচটি ধাপে ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছে গোটা প্রকল্প জুড়ে। পাথরঘাটার চরদুয়ানী, কালমেঘা, পাথরঘাটা সদর ও কাঠালতলী ইউনিয়ন, বরগুনা সদরের নলটোনা ও এম বালিয়াতলী ও বামনার ডৌয়াতলা ইউনিয়নে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের তালিকায় নাম নিশ্চিত করতে তিন থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে গ্রাহকের কাছ থেকে। যারা টাকা দিতে পারেনি, তাদের নাম আসেনি তালিকায়।
পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা ও প্রকল্পের আওতায় সুবিধাভোগী মো. হারুন, সেলিম ঘরামি, কামাল খান, মন্নান খান, আ. রহিম, হাকিম আকনসহ একাধিক সুবিধাভোগী অভিযোগ করে বলেন, “সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম কবিরকে টাকা দিতে হয়েছে এই প্রকল্পের তালিকায় নাম ওঠাতে।”
একাধিক সুবিধাভোগী অভিযোগ করে বলেছেন, “সাবেক সংসদ সদস্য শওকত হাসানুর রহমান রিমনের লোকজন তালিকায় নাম ওঠানো নিশ্চিত করতে তাদের কাছ থেকে তিন থেকে ছয় হাজার টাকা করে নিয়েছেন।”
একই অভিযোগ করেছেন বরগুনা সদরের দুটি ইউনিয়নের প্রকল্পের আওতায় আসা সুবিধাভোগীরাও। নলটোনা এলাকার হিরু মল্লিক, রাসেল মিয়া, মোসা. মাসুরাসহ অনেকেরই এমন অভিযোগ।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, টেন্ডারের প্রথম বিল উত্তোলনের জন্য কিছু কিছু বাড়িতে তিন হাজার লিটার পানি ধারণ ক্ষমতার ট্যাংকি রাখার প্লাটফর্ম তৈরি করেছেন ঠিকাদার। তবে, নিম্নমানের কাজ করায় ট্যাংকি স্থাপনের আগেই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে সেসব প্লাটফর্ম।
পাথরঘাটার চরদুয়ানী এলকার মোস্তফা হাওলাদার ও মিল্টন সমাদ্দার বলেন, “তিন বছর আগে তড়িঘড়ি করে নিম্নমানের প্লাটফর্ম বানিয়ে ফেলে রেখে গেছেন ঠিকাদার। তারপর আর কোন খোঁজ নেই। ট্যাংকিও দেয়নি। ট্যাংকি রাখার আগেই প্লাটফর্ম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।”
সরেজমিনে অনুন্ধান করে দেখা যায়, প্রতিটি ইউনিয়নে লোক দেখানো কিছু কিছু ট্যাংকি বিতরণ করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে সেসব ট্যাংকি খুবই নিম্নমানের। এছাড়া পানি সংরক্ষণের জন্য ফিটিংসের সব মালামাল দেয়ার কথা থাকলেও কিছুই করেনি ঠিকাদার।
পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নে প্রকল্পের আওতায় এসেছেন হানিফা, তুহিন ইব্রাহিমসহ অনেকে। তারা বলছেন, “ছয় মাস আগে নিম্নমানের ট্যাংকি দিয়েছে ঠিকাদার। তবে ফিল্টারসহ অন্যান্য ফিটিংসের কিছুই দেয়নি। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কোন পদক্ষেপও নিচ্ছে না।”
২০২২-২০২৩ অর্থবছরে পাথরঘাটার চরদুয়ানী এলাকার মোস্তফা হাওলাদার বাড়ির মসজিদের সামনে এবং মিল্টন সমাদ্দারের বাড়ির মন্দিরের পিছনে দুটি পানির ট্যাংকি এবং শেড পাওয়ার কথা থাকলেও মসজিদ ও মন্দির ঘুরে দেখা যায়, আড়াই বছর আগে ট্যাংকি রাখার প্লাটফর্ম করে চলে গেছে ঠিকাদার। এছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ২০২২-২০২৩ ও ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের তালিকা ধরে পাথরঘাটা ও সদর উপজেলা ঘুরে দেখা যায়- ট্যাংকি না পাওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বরগুনা সদরের নলটোনা ইউনিয়নের গাজী মাহমুদ এলাকার বেল্লাল হোসেন, আবু হানিফা, সহিদুল ইসলাম, ইদ্রিস, আলী আকবর ও মন্টু মোল্লসহ বেশিরভাগ পরিবার রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্রকল্পের আওতায় আসার কথা থাকলেও অর্থবছর শেষ হলেও কিছুই পায়নি।
গোটা প্রকল্পে প্রতিটি ধাপে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে এসেছে অনুসন্ধানে। বরগুনা সদরের ৯নং এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের মাইঠা এলাকা। এই এলাকায় সুপেয় পানির কোন সংকট নেই। অধিকাংশ বাড়িতেই রয়েছে গভীর নলকূপ। সেসব নলকূপ থেকে সুপেয় পানি পাচ্ছেন বাসিন্দারা। এই এলাকার স্বচ্ছল বাসিন্দা আবুল হোসেন, ফরহাদ হোসেন, মনির খান, শহিদুল ইসলামসহ অসংখ্য পরিবারের নাম রয়েছে ওই তালিকায়। অথচ তালিকাভুক্তদের অনেকের বাড়িতেই গভীর নলকূপ ও সুপেয় পানির পুকুর রয়েছে।
পাথরঘাটা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বাসিন্দারা যখন সুপেয় পানির সংকটে দিশেহারা, পাশ্ববর্তী উপজেলা বামনার ডৌয়াতলা ইউনিয়নে পানি সংকট না থাকলেও এই ইউনিয়নের ৫৬২ জন তালিকাভুক্ত হয়েছেন এই প্রকল্পে।
উপকূলীয় ১০ জেলার মানুষের জন্য নিরাপদ বৃষ্টির পানি সরবরাহ করতে আওয়ামী লীগ সরকার ৯৬১ কোটি ৭৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প গ্রহণ করেন। এর মধ্যে বরগুনা, সাতক্ষীরা ও পটুয়াখালী জেলায় দরপত্র পায় কামাল এন্টারপ্রাইজ।
এ বিষয়ে কামাল এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী ঠিকাদার কামাল হোসেন বলেন, “কিছু প্লাটফর্ম বৃষ্টির মৌসুমে নির্মাণ করা হয়েছে, তাই সমস্যা হয়েছে। এছাড়া তালিকাভুক্ত সবাই ট্যাংকসহ সবকিছুই পাবেন, একটু সময় লাগবে।”
এসব বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রাইসুল ইসলাম দাবি করেছেন, “প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। এখনো কাজ চলমান আছে।”
২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের সুবিধাভোগীরা কেন অর্থ বছর শেষ হওয়ার পরেও প্রকল্পের মালামাল পায়নি? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক কারণে কিছুটা সময় লেগেছে। সবাই ট্যাংকিসহ সব মালামাল পাবেন।”
পাথরঘাটা উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা মো. রোকনুজ্জামান খান বলেন, “অনিয়ম-দুর্নীতির কিছু অভিযোগ পেয়েছি। ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের ট্যাংক এখনো অনেক পরিবার পায়নি। এটা আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি। বিষয়টি জানার পর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি। কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে অগ্রগতি সম্পর্কে আমাকে লিখিতভাবে জানাতে বলেছি। ঠিকাদারদের সাথেও কথা বলেছি। ঠিকাদারকে কঠোরভাবে বলেছি। এখন থেকে এই কাজ আমিও তদারকি করব। আমার উপজেলায় কোন অনিয়ম দুর্নীতি সহ্য করা হবে না।”
বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, “আমি সদ্য দায়িত্ব নিয়েছি। বিষয়গুলো আমাকে জানতে হবে, না জেনে এ বিষয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না।”