ঢাকা
১১ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
সকাল ১০:১৬
logo
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫

এজেন্সির লোভে টিকিট দুর্মূল্য

অতিমুনাফালোভী কিছু ট্রাভেল এজেন্টের লোভের মাশুল গুনছে প্রবাসীসহ সাধারণ বিমান যাত্রীরা। এই চক্রের সিন্ডিকেটের কবজায় বিমানের টিকিট বাণিজ্য। তারা এয়ারলাইনসগুলোর টিকিট আগাম ব্লক করে নিজেদের জিম্মায় রেখে পরে ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে। ফলে বিদেশগামী বিমানের যাত্রীদের স্বাভাবিক ভাড়ার তিন গুণ পর্যন্ত বেশি টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে হচ্ছে।

যাত্রী, কর্মী ও ট্রাভেল এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। জানা যায়, ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার টিকিট তাদের সিন্ডিকেটের কারণে কিনতে হচ্ছে এক লাখ ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

বিভিন্ন সূত্র বলছে, মধ্যপ্রাচ্যের এয়ারলাইনস ব্যবসায়ী ও দেশীয় কিছু ট্রাভেল এজেন্সির মধ্যে প্রভাবশালী এক সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। তারা বিভিন্ন এজেন্সির চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও যাত্রীদের কোনো প্রকার পাসপোর্ট, ভিসা ও ভ্রমণ নথিপত্র ছাড়াই শুধু ই-মেইলের মাধ্যমে কিছু এয়ারলাইনসের বিভিন্ন রুটের গ্রুপ সিট বুকিং করে থাকে।

এই সিন্ডিকেট দু-তিন মাস আগে অগ্রিম তারিখের পিএনআর তৈরি করে সিট ব্লক করে রাখে। কিন্তু এই পিএনআরে কোনো যাত্রীর নাম উল্লেখ থাকে না। এজেন্সি বা যাত্রীর ওই ফ্লাইটের টিকিট খালি আছে কি না তা জানার কোনো সুযোগ থাকে না। টিকিট খুঁজতে গেলে সেখানে সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে—এমন বার্তা আসে।
টিকিটের কৃত্রিম সংকটকে কাজে লাগিয়ে তখন এর দাম বাড়িয়ে পকেটে পোরে ওই চক্র।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মূলত বিদেশি মধ্যপ্রাচ্যগামী এয়ারলাইনসগুলো ফ্লাইটের তারিখের অনেক আগেই আসন বিক্রি নিশ্চিত করা এবং অধিক মুনাফার জন্যই এই পদ্ধতি অবলম্বন করে রিয়াদ, দাম্মাম, জেদ্দা, ওমান, দোহা, কুয়ালালামপুরসহ বিভিন্ন রুটের সিট ব্লক করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যগামী এয়ারলাইনসগুলো এ ধরনের নাম ছাড়া গ্রুপ বুকিং করে তাদের পছন্দের গুটিকয়েক এজেন্সির মাধ্যমে বাজারে টিকিট বিক্রি করে।

চলতি বছরের গত ২৬ জানুয়ারি উড়োজাহাজের ৬০ হাজার টিকিট সিন্ডিকেট ব্লক করেছে বলে অভিযোগ করে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)। এ সময় আটাব বলে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান পরিবহন খাতে চলমান অন্যতম বড় সমস্যা এয়ার টিকিটের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি।

এই মূল্যবৃদ্ধির নেপথ্যে অন্যতম প্রধান কারণ নামবিহীন গ্রুপ টিকিট বুকিং। কিছু মধ্যপ্রাচ্যগামী এয়ারলাইনস দেশীয় কিছু ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে ৬০ হাজার টিকিট ব্লক করে রেখেছে। এর ফলে টিকিটের মূল্য ২০ থেকে ৫০ শতাংশ, কখনো দু-তিন গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ বিষয়ে আটাব সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে সৌদি আরবে বা মালয়েশিয়ায় যখন কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় তখন সিন্ডিকেট গ্রুপ টিকিট অর্থাৎ নাম, পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়া এয়ারলাইনসগুলো থেকে টিকিট ব্লক করে রাখে। তখন ফ্লাইটের টিকিট বিক্রি না হলেও ব্লক করার কারণে ভাড়া বেশি হয়ে যায়।’

সিন্ডিকেটের বিষয়ে তিনি আরো বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে যেসব এয়ারলাইনস ফ্লাইট পরিচালনার কাজ করে তারাই হলো সিন্ডিকেট। এই এয়ারলাইনসগুলো চায় বাংলাদেশ থেকে বেশি লাভ করতে। যেহেতু আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেভাবে মনিটর করে না বা যতটুকু করে সেটা পর‌্যাপ্ত নয়, সে কারণে তারা সুযোগ পেয়েছে এবং এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে যত বেশি ব্যবসা করা যায় সেটিই তারা করছে। বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো এখানে জনগণের উপকার করতে আসেনি। তারা আসছে এখান থেকে বেশি অর্থ আয় করতে।’

আর এই সমস্যা সমাধানে বিমান মন্ত্রণালয় ও সিভিল এভিয়েশনকে ভূমিকা রাখতে হবে বলে জানিয়েছেন আটাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ভূইয়া। তিনি বলেন, ‘এ পরিস্থিতি বন্ধ করতে হলে বিমান মন্ত্রণালয় ও সিভিল এভিয়েশনকে ভূমিকা নিতে হবে। তাহলে টিকিটের মূল্যবৃদ্ধি বন্ধ করা সম্ভব। তা না হলে এটি কখনোই করা সম্ভব হবে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘এখান থেকে উত্তরণ করতে হলে যারা গ্রুপ করছে তাদের গ্রুপ বন্ধ করে দিলে সিট ব্লকও করতে পারবে না এবং একটি সিটও খালি থাকবে না আর টিকিটের দামও এত বৃদ্ধি পাবে না। মন্ত্রণালয়কে একটা কাজ করতে হবে, তা হলো এয়ারলাইনসগুলোকে বলতে হবে, তোমরা কোনো ব্লক দিতে পারবে না। ব্লক দিতে হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যাত্রীর নাম দিয়ে দিতে হবে। এখন তুমি যখনই টিকিট ব্লক দাও। এই শর্ত দিয়ে দিলে একটা লোকও ব্লক দিতে পারবে না। কারণ যারা ব্লক দেয় তারা সবাই শেষ মুহৃর্তে টিকিট বিক্রি করে।’

লাগামহীনভাবে টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রী, কর্মী ও সাধারণ ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসায়ীরা। তাঁরা এখন হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ আবার বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত মূল্যেই টিকিট ক্রয় করছে।

এই রকমই এক হতাশার কথা জানান ইউরোপা ট্রাভেলসের পরিচালক মো. আনোয়ার হোসাইন। তিনি বলেন, ‘টিকিটের দাম তো লাগামহীনভাবে বাড়ছে। এর ফলে আমাদের কাজেও ভাটা পড়ছে। বলতে পারেন, আমরা একেবারে আশা ছেড়ে দিয়েছি। টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের প্যাকেজের মূল্যও বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে যাত্রী ও কর্মীরা যাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে। তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।’

আরেক ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসায়ী তাওহিদুল তানিম বলেন, ‘দাম বাড়ার কারণ হলো কিছু ট্রাভেল এজেন্সি, যারা নাম ছাড়া ৫০ থেকে ১০০টি টিকিট কিনে ফেলে। এরপর তারা এই টিকিট এক লাখ টাকা থেকে শুরু করে এক লাখ ১০-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে। বাংলাদেশ বিমানও তাদের টিকিট ব্লক করে রাখে। সিস্টেমে কোনো টিকিট পাওয়া যায় না। কিন্তু বড় বড় কর্মকর্তা এজেন্সির কাছে টিকিট বিক্রি করে।’

শুধু ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসায়ীরাই নন, অধিক হারে টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় রেমিট্যান্স পাঠানো কর্মীরাও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তাঁরা এক লাখ ১০-২০ হাজার টাকার চেয়েও বেশি টাকা দিয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছেন। তেমনি একজন সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী ইমরান হোসাইন। কোথাও টিকিট না পেয়ে এক লাখ ৬৯ হাজার টাকা খরচ করে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত যান। ইমরান হোসাইন বলেন, ‘আমি গত বছরের ডিসেম্বরে দেশে ঘুরতে এসেছিলাম। সে সময়ও ৭০ হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কিনে আসি। কিন্তু চলতি বছর টিকিটের দাম অনেক বেশি হয়েছে। আমি জানুয়ারির শেষ দিকে যখন টিকিট খোঁজা শুরু করলাম তখন দেখি কোথাও কোনো টিকিট নেই। পরে অনেক খুঁজে ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে এক লাখ ৬৯ হাজার টাকা দিয়ে একটি টিকিট পেয়েছি। এটি আমাদের ওপর এক ধরনের জুলুম।’

উড়োজাহাজের টিকিটের বিষয় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এপ্রিল মাস থেকে হজের আগ পর্যন্ত সৌদি আরবে একটি কাফেলা যায়। আর হজের পর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ওমরাহ করতে যায় ২০ থেকে ২২ হাজার মানুষ। এই সময়টাতে টিকিটের মূল্য সাধারণ অবস্থার মধ্যে থাকে। ডিসেম্বর মাস শুরু হলে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেশির ভাগ মানুষ ওমরাহ ও ভ্রমণ ভিসায় সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যায়। এই সময়টাতে টিকিটের মূল্য স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বৃদ্ধি পায়। তবে বর্তমানে এই মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে দু-তিন গুণ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ হজ-ওমরাহ মুয়াল্লিম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কে এম আবু হানিফ হৃদয়। তিনি বলেন, ‘এ বছর আমাদের ওমরাহর টার্গেট ছিল ৭২ থেকে ৮০ হাজার। বর্তমানে প্রতিদিন ট্রাভেল এজেন্সির কাছে ২০০ থেকে ২৫০টি পাসপোর্ট থাকছে। কিন্তু কোথাও কোনো টিকিট নেই। যখন এত বড় টার্গেট নেওয়া হয়েছিল, ঠিক এ সময় সিন্ডিকেটের সদস্যরা এক দিনের মধ্যে ২১ হাজার টিকিট ব্লক করে ফেলে। এভাবে তারা ৬০ হাজার টিকিট ব্লক করে ফেলে। এই ৬০ হাজার টিকিট ব্লক করার ফলে বাজারে টিকিটের সংকট তৈরি হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সম্প্রতি সৌদি এয়ারলাইনস ঢাকা থেকে জেদ্দা হয়ে আবার ঢাকা আসার মূল্য নির্ধারণ করেছিল ৮১৫ ডলার। এটা ছিল ১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত। ১৬ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ তা দিয়েছিল ৮৫০ ডলার। ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত মূল্য দিয়েছিল ৭৪০ ডলার। এগুলো সব হিসাব করলে এক লাখ থেকে এক লাখ দুই হাজারের মধ্যে থাকে। কিন্তু সেই জায়গায় এখন টিকিটের বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১০ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। আর যদি কোনো ব্যক্তি জরুরি ভিত্তিতে দু-এক দিন আগে টিকিট কেনে তাকে এক লাখ ৬০ হাজারের ওপরে দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে।’

তবে টিকিট ব্লকসহ কৃত্রিম মজুদ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সাফিকুর রহমান। সম্প্রতি তিনি বলেন, ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে আগাম সিট বুকিং, টিকিট ব্লকসহ কৃত্রিম মজুদ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা হয়েছে। টিকেটিং নিয়ে কারসাজিতে অভিযুক্তদের বিষয়ে তথ্য পেলেই তাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’

সাম্প্রতিককালে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গন্তব্যের প্লেনের টিকিট ব্লক ও কৃত্রিম মজুদের বিষয়ে এমডি বলেন, ‘বিষয়টি আমি নিজে মনিটর করি। এটা নিয়ে আগে কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের টিকেটিংয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে অন্য বিভাগে পাঠানো হয়েছে।’

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram