মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মানবিক করিডর চালুর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা বিএনপির মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এই বিষয়ে প্রকৃতপক্ষে কী হয়েছে, তা সরকারের কাছে জানতে চাইবে দলটি।
গতকাল সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও দলের নীতিনির্ধারকরা এই সিদ্ধান্তে উদ্বেগ, ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাঁরা এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন।
গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, প্রয়োজনে সরকারকে এই পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে রাজনৈতিক চাপ তৈরি করবেন। তাঁরা সতর্ক করে এও বলেন, এই পদক্ষেপ বাংলাদেশকে ফিলিস্তিনের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে পারে।
বৈঠকে এই ইস্যুতে সরকারকে চিঠি দেওয়ার পরামর্শ দেন কয়েকজন নেতা। প্রয়োজনে দলটি সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে এবং একই সঙ্গে সরকার কী করতে যাচ্ছে এবং রাখাইনের বাস্তব পরিস্থিতি কী, সে সম্পর্কে তথ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ করবে। পরে জাতির সামনে তথ্য ও যুক্তির ভিত্তিতে পুরো বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে জানতে চাইব, মানবিক করিডরের বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কোনো পক্ষের সঙ্গে তাদের আলোচনা হয়েছে কি না? হলে তাতে কী শর্ত আছে, কেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো? সরকারের বক্তব্য জানার পর আমরা পরবর্তী করণীয় ঠিক করব।
গত শনিবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ঘোষণা করেন, সরকার জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কিছু শর্তে একটি মানবিক করিডর অনুমোদনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে তিনি এ বিষয়ে আর কোনো বিস্তারিত তথ্য দেননি।
গতকাল সোমবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারকে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। কারণ এটি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ শান্তি ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িত।
বিএনপি মহাসচিব আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘এই ধরনের করিডর গাজার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় সাহায্য পাঠাতে ব্যবহৃত হয়েছে। আমরা চাই না আমাদের দেশ আরেকটি গাজা হয়ে যাক…আমরা আর যুদ্ধ চাই না। আমরা চাই না কেউ এসে আমাদের দেশে অশান্তি তৈরি করুক। আমরা এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের কারণে বড় সংকটে আছি।’
মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের মাধ্যমে দলের অবস্থা প্রকাশ পেয়েছে। এই বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পর সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে একইভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নীতিনির্ধারক বলেন, ‘আমরা বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। এমন স্পর্শকাতর ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে পদক্ষেপ নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থায়ী কমিটি।’ তাঁরা মনে করেন, জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া একটি অনির্বাচিত সরকারের এমন জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো অধিকার নেই।
বৈঠক সূত্র জানায়, মায়ানমারে বর্তমানে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। সেখানে সামরিক জান্তা ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত চলছে। আরাকান আর্মিকে দমন করতে জান্তা সরকার সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ মানবিক করিডর দেবে কি না এবং সেটি দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে কি না, তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা করা হয়েছে।
বৈঠকে বিএনপি নেতারা অভিমত দেন যে বাংলাদেশ মানবিক কারণে এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে যে বোঝা বহন করছে, এখন নতুন আরেকটি সমস্যায় জড়ানো উচিত হবে না।
স্থায়ী কমিটির আরেকজন নেতা এই বিষয়ে বলেন, জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী রাখাইন বর্তমানে একটি গুরুতর মানবিক সংকটে রয়েছে। সে কারণে তাঁরা রাখাইনের জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল। তবে মানবিক করিডর ইস্যুতে প্রতিবেশী দেশগুলো, বিশেষ করে চীন ও ভারতের অবস্থান কী, সেটাও জানা জরুরি।
বিএনপির নীতিনির্ধারক সালাহউদ্দিন আহমদ আরো বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের নিরাপত্তা, শান্তি, শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সঙ্গে জড়িত। একটি ম্যান্ডেটহীন অরাজনৈতিক সরকারের পক্ষে এত বড় জাতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনোভাবেই সমীচীন নয়।’
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘মায়ানমারের কোনো পক্ষের সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষ সৃষ্টি হতে পারে—এমন পদক্ষেপ নেওয়া বাংলাদেশের জন্য সাংঘাতিক ঝুঁকিপূর্ণ। এতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তাই সার্বিক বিবেচনায় সব রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তির সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।’