মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পরবর্তী সপ্তাহে বৈঠকের কথা ভাবছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বৈঠকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়টিই গুরুত্ব পাবে। তবে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন কেন এখনই যুদ্ধ শেষ করতে আগ্রহী পুতিন। প্রায় তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধের মাধ্যমে রুশ প্রেসিডেন্ট বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি রক্তপাতকে পাত্তা দেয় না। এছাড়া কিয়েভে রাশিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই যদি পুতিনের লক্ষ্য হয় তাহলে তিনি তা অর্জন থেকে দূরে রয়েছেন। যাইহোক শত জল্পনা-কল্পনা সত্ত্বেও এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে আলোচনার টেবিলে বসতে যাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট।
এ খবর দিয়ে দ্য পলিটিকো বলছে, যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ব্যয়ের ফলে আর্থিক সংকটে পড়তে যাচ্ছে রাশিয়া। দেশটির স্বাভাবিক আর্থিক পরিস্থিতির যে বর্ণনা দেখা যায়, রাশিয়ার বাজেট ঘাটতি তুলনামূলক কম। এছাড়া দেশটির সরকারি ঋণও কম। স্বাভাবিকভাবে এই হিসাব দেশটির রাজস্বের মানদণ্ডকে শক্তিশালী রেখেছে বলেই বোঝা যায়। এই বিশ্লেষণ বেশিরভাগ দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্ত এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে: পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে মস্কোর আর্ন্তার্জাতিক বাজারে প্রবেশের সক্ষমতা সীমিত হয়েছে। কেননা যুদ্ধে প্রবল ব্যয়ের ফলে রাজস্ব ঘাটতি কাটাতে যে পরিমাণ অর্থায়ন প্রয়োজন ক্রেমলিনের কাছে সুযোগ সীমিত।
দেশের বাইরের ঋণের সমীকরণের বাইরে থাকায় মস্কোর প্রাথমিক পরিকল্পনাই ছিল আভ্যন্তরীণ ব্যাংকগুলোকে সার্বভৌম ঋণ ক্রয়ে বাধ্য করা। এই কৌশলটি ২০২২ এবং ২০২৩ সালে ভালোভাবে কাজ করলেও গত বছর এতে ফাটল দেখা দেয়। প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলোকে শত শত বিলিয়ন সস্তা ঋণ দেয়ার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বন্ড ক্রয়ের ফলে অর্থনৈতিকভাবে চাপের মুখে পড়ে ক্রেমলিন। এতে রুশ ব্যাংকগুলো নগদ অর্থের সংকটে পড়ে। এছাড়া গত বছর ক্রেতার অভাবে ক্রেমলিনকে দেশীয় ঋণ ইস্যুর জন্য বেশি কয়েকটি নিলাম বাতিল করতে হয়েছে। সুতরাং অভ্যন্তরীণ ঋণ ক্রমশ সমীকরণের বাইরে চলে যাওয়ায় তাদের প্ল্যান সি অনুযায়ী জাতীয় কল্যাণ তহবিলের রিজার্ভ ব্যবহার করা শুরু করেছে মস্কো।
কাগজে কলমে এটি যুক্তিসঙ্গত কৌশল বলে মনে হচ্ছে। ২০২২ সালের গোড়ার দিকে যুদ্ধের ঘাটতি পূরণের জন্য মোট বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১০ ট্রিলিয়ন রুবল বা ১১০ বিলিয়ন ডলার। সেসময় এই সংখ্যাটিকে যথেষ্ট বলে ধরে নেয়া হয়। তবে যুদ্ধের তিন বছর পর দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ একদম তলানীতে পৌঁছেছে। ইতিমধ্যেই রিজার্ভ প্রায় ৬০ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়েছে।
এসব হিসাব নিকাশ থেকে সহজেই বুঝা যাচ্ছে চলতি বছরটি ক্রেমলিনের জন্য আর্থিক দিকে দিয়ে বেশ চ্যালেঞ্জের হবে। এ বছরের জানুয়ারিতে যে বাজেট ঘাটটি উল্লেখ করা হয়েছে তা ২০২৫ সালের পূর্ণ বছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ বেশি।
মস্কোর এই তথ্যটি উদ্বেগজনক বলেই মনে হচ্ছে। যদি বছরের বাকি মাসে রাজস্ব ব্যয় জানুয়ারির মতো থাকে তাহলে দেশটির রিজার্ভ তিন মাসের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যাবে। তবে যদি সেটা না হয় তাহলে বাকি রিজার্ভ কাজে ২০২৫ সালের মধ্যেই আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করবে মস্কো।
এই পরিস্থিতিতে যে প্রশ্নটি উঠেছে তা হচ্ছে- যদি রাশিয়ার বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য অর্থ ফুরিয়ে যায়, তাহলে কী হবে?
অতিরিক্ত ঋণের ফলে দেশের ব্যাংকগুলোর প্রায় স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। যার ফলে দেশটির আর্থিক সংকট প্রবল হতে পারে। আর যদি এমনটি ঘটে তাহলে রাশিয়ার ব্যাংকিং সেক্টর স্বাভাবিক রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা পুনঃমূল্যায়ন শুরু করার জন্য কোনো অর্থের জোগান থাকবে না। মস্কোর অর্থনীতি যেভাবে তাসের ঘরে পরিণত হয়েছে তা অচিরেই ভেঙ্গে পড়তে শুরু করবে।
আর্থিক দিক চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, রাশিয়ার সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। বাজেট ঘাটতি পূরণ করার জন্য ক্রেমলিনের কাছে কার্যকর কোনো পরিকল্পনা নেই। ফলত যুদ্ধের তহবিল নিয়ে এখন বড় সংকটে পড়েছে মস্কো। এই দিকটি বিবেচনায় নিলে- পুতিন আসলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তার আর্থিক সংকট কাটিয়ে ওঠার যায়গাটি খুঁজছেন বলেই মনে হচ্ছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এড়াতে চাইবেন। বিশেষ করে বিদেশী ঋণ পেতে যেন কোনো বাধা না থাকে সে বিষয়টি জোর দেবেন পুতিন। অথবা সংঘাতে বিরতি দিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করবে রাশিয়া।
২০২৪ সালের সেপ্টম্বরে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা প্রধান কিরিলো বুদানভ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, ২০২৫ সালের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করার জোর প্রচেষ্টা চালাবে মস্কো। বর্তমানে মস্কোর যে অবস্থা তাতে বুদানভের কথারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। সুতরাং কেন ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় বসতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তা একম স্পষ্ট। তিনি চাননা যে তার দেশ দেউলিয়া হয়ে যাক।
(লেখক: আগাথে দেমারাই। তিনি ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস-এর একজন সিনিয়র পলিসি ফেলো)